শেয়ারবাজারে প্রধান উদ্বেগ এখন ‘লেনদেন’। হঠাৎ করে বাজারের লেনদেন অনেক কমে গেছে। এ কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী সবার মাঝেই ছড়িয়েছে উদ্বেগ। লেনদেন কমে যাওয়ায় সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এ লেনদেন কমে যাওয়া সত্যিই কি অপ্রত্যাশিত নাকি যৌক্তিক।
এ প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ হয়তো বলবেন, লেনদেন কমে যাওয়াটা অযৌক্তিক।
আবার আরেকটি অংশ বলবেন, লেনদেন কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। লেনদেন বাড়িয়ে শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে এক দিন লেনদেন বাড়ে তো আরেক দিন কমে।
বাজারের লেনদেন হওয়া ৩৯০টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩২৩টিই এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইসে নেমে গেছে। তাতে এসব কোম্পানির খুব বেশি শেয়ারের লেনদেন হচ্ছে না। ফলে কোম্পানিগুলোতে আটকে আছে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের অর্থ।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তখনই শেয়ার কেনেন, যখন তার হাতে কেনার মতো অর্থ থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ভালো ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করে অনেকে আটকে গেছে। ফলে তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতা অনেক কমে গেছে।
প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, এসিআই, বাটা শু, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি), বার্জার পেইন্টস, ব্র্যাক ব্যাংক, গ্রামীণফোনসহ ভালো ভালো সব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে নেমেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভালো মানের ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস–৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ২৫টিই ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে।
ফলে এসব শেয়ারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আটকে গেছে। এ ক্ষেত্রে বেশি বিপদে পড়েছেন ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। যাঁরা ঋণ নিয়ে ভালো ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন এসব শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে তাঁদের শেয়ার লেনদেন না করেও গুনতে হচ্ছে ঋণের সুদ।
বাজারের গতি কমে যাওয়ায় এবং বেশির ভাগ শেয়ার সর্বনিম্ন মূল্যস্তরে নেমে আসায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এখন ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ারও সাহস করছে না। সংস্থাটির শঙ্কা, তাতে বাজার আরও পড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে ফ্লোর প্রাইসের কারণে নতুন বিনিয়োগও বাজারে আসছে না। ফলে বাজারে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। লেনদেন নেমেছে তলানিতে।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, যদি সব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসে, তখন লেনদেন আরও কমে যেতে পারে। তখন বাজারে একধরনের স্থিতাবস্থা নেমে আসবে।
জানতে চাইলে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, ভালো ভালো অনেক কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসায় অনেকের বিনিয়োগ আটকে গেছে। আবার নতুন করে যাঁরা বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা করছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে তাঁরাও বিনিয়োগে সাহস করছেন না। শেয়ার কিনে যদি বিক্রি করা না যায়, তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বাড়ে। যার প্রভাব পড়ে বাজারে।
মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘কৃত্রিমভাবে বাজার ধরে রাখতে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে লেনদেন কমে গেছে। অতীতেও আমরা দেখেছি কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম ও বাজার কোনোটিই শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যায় না। বাজারকে বাজারের নিয়মেই চলতে দিতে হয়। তাতে দাম কমে গেলেও কম দাম দেখে অনেক বিনিয়োগকারী নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্চেন্ট ব্যাংকের এক শীর্ষ নির্বাহী বলেন, বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানিসহ ভালো মৌলভিত্তির কিছু শেয়ারে দুই মাস ধরে তাদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে গেছে। এসব কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকায় লেনদেনও করতে পারছে না। ফলে তাদের প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের পরিমাণও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কমে গেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে গতি কমে যাওয়ায় এবং পতনের ধারায় থাকায় এখনই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার মতো বাস্তবতাও নেই। তাই ফ্লোর প্রাইস না তুলে বাজারে কীভাবে লেনদেন বাড়ানো যায়, সেই পথ খুঁজছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ব্লক মার্কেটে ফ্লোর প্রাইসের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার লেনদেনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতেও নানামুখী চেষ্টা চলছে।