‘কৃত্রিম শেয়ারবাজার’ কার ও কী কাজে লাগছে

২০২০ সালে করোনার ধাক্কা সামাল দিতে শেয়ারবাজারে প্রথম ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালু করা হয়। তাতে প্রায় তিন বছর ধরে বাজারটি রূপ নিয়েছে এক ‘কৃত্রিম’ বাজারে। ফলে বাজারের সুফল কেউই পাচ্ছে না।

শেয়ারবাজার

তিন বছর ধরে দেশের শেয়ারবাজার রূপ নিয়েছে ‘কৃত্রিম’ বাজারে। যার ফলে বাজারের বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কারা এ কৃত্রিম বাজারের সুফলভোগী, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

স্বাভাবিক শেয়ারবাজারকে ‘কৃত্রিম’ বাজারে রূপ দিয়েছে শেয়ারের বেঁধে দেওয়া ‘সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস’। বাজারের সব পক্ষই এখন ফ্লোর প্রাইস যন্ত্রণায় ভুগছে।  

২০২০ সালে করোনার প্রকোপ শুরুর পর ওই বছরের ১৯ মার্চ শেয়ারবাজারে প্রথম ‘ফ্লোর প্রাইস’ ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর মাধ্যমে শেয়ারের সর্বনিম্ন একটি দাম বেঁধে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট ওই সীমার নিচে নামতে পারছে না। মূলত বাজারের পতন ঠেকাতেই এ ব্যবস্থা চালু করা হয়।

কিন্তু গত তিন বছরে এই ফ্লোর প্রাইস বাজারকে বলতে গেলে অকার্যকর এক বাজারে পরিণত করেছে। তবে মাঝে একাধিকবার ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার ও সমন্বয় করা হয়েছে। তবে বাজার স্বাভাবিক ধারায় না ফেরায় তা আবার ফিরে এসেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সাময়িক এ ব্যবস্থা।

পড়তি বাজারে এখনই এই ফ্লোর প্রাইস তোলা হবে না বলে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। তিনি বলেছেন, বাজার তার স্বাভাবিক ধারা তথা ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরলে ব্যবস্থাটি তুলে নেওয়া হবে। ফলে কখন এটি উঠবে বা বর্তমান ব্যবস্থায় আদৌ বাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।

বর্তমান বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা ভুগছেন আস্থার সংকটে। আর বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারাও রয়েছে বড় ঝুঁকিতে। কারণ, বাজারে স্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়রোজগারে টান লেগেছে। বছরের পর বছর বাজার বড় অঙ্কের লোকসান বইতে না পেরে ছোট ও মাঝারি মানের অনেক ব্রোকারেজ হাউস নিজেদের ব্যবসা আরও ছোট করে এনেছে। কেউ কেউ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারবাজার একটি ‘কৃত্রিম’ বাজারে রূপ নিয়েছে। বর্তমান এ বাজার কারোরই কোনো কাজে লাগছে না। উল্টো দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের ক্ষতি হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির অধিকার ক্ষুণ্ন করছে এ ব্যবস্থা
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের আয়েরও বড় উৎস শেয়ারবাজারের লেনদেনের কমিশন আয়। ‘কৃত্রিম শেয়ারবাজার’ সেই আয়েও টান ধরিয়ে দিয়েছে। ফলে স্টক এক্সচেঞ্জের কমিশন বাবদ আয়ও কমে গেছে। তাতে স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালন মুনাফার বড় উৎস হয়ে উঠেছে এখন ব্যাংকে রাখা অর্থের সুদ আয় ও তালিকাভুক্তির মাশুল বা ফি।

শেয়ারবাজারের বর্তমান ‘ফ্লোর প্রাইস’ বিনিয়োগকারীদের কীভাবে ভোগান্তিতে ফেলেছে, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাজারে তালিকাভুক্ত দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষস্থানীয় একটি কোম্পানির বড় এক কর্মকর্তা সম্প্রতি প্রথম আলোকে জানালেন তাঁর দুর্বিষহ অবস্থার কথা। ২০–৩০ বছরের বেশি সময় ধরে অল্প অল্প করে তিনি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন।

তাতে তাঁর বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কয়েক কোটি টাকায়। সম্প্রতি ওই কর্মকর্তা চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা জানান, তাঁর বিনিয়োগের সিংহভাগই শেয়ারবাজারের ভালো মানের শীর্ষ ৩০ কোম্পানির কয়েকটিতে পুঞ্জীভূত। সম্প্রতি তাঁর স্ত্রী জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর একমাত্র কন্যা বিদেশি পড়াশোনার জন্য গেছেন। এ জন্য তাঁর হঠাৎই খুব টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু জীবনের এ কঠিন সময়ে তিনি শেয়ারবাজারে তাঁর বিনিয়োগের অর্থের কোনো সুফলই পাননি। কারণ, যেসব শেয়ারে তার বিনিয়োগ, তার বেশির ভাগেরই দাম ‘ফ্লোর প্রাইসের’ আটকে আছে। ফলে এসব শেয়ারের কোনো কেনাবেচা হচ্ছে না। তাই তিনি বাজার থেকে তাঁর বিনিয়োগের কোনো অর্থই তুলতে পারেননি।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জোর করে শেয়ারের বিক্রি বা ফোর্সড সেল বন্ধে এ ব্যবস্থাটি করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজারের পতন নিয়ে একধরনের আতঙ্ক ভর করে। সেই আতঙ্ক দূর করতে শেয়ারের দাম বেঁধে দেওয়া হয়। ব্যবস্থাটি সাময়িক। বাজার স্বাভাবিক ধারায় ফিরলে আবারও ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হবে।

জোর করে শেয়ারের বিক্রি বা ফোর্সড সেল বন্ধে এ ব্যবস্থাটি করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজারের পতন নিয়ে একধরনের আতঙ্ক ভর করে। সেই আতঙ্ক দূর করতে শেয়ারের দাম বেঁধে দেওয়া হয়। ব্যবস্থাটি সাময়িক
মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মুখপাত্র, বিএসইসি

সম্প্রতি শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে। যিনি আবার পুঁজিবাজার বিশ্লেষকও। আলাপকালে তিনি জানান, ফ্লোর প্রাইসের কারণে তাঁর নিজের বিনিয়োগও কয়েক বছর ধরে আটকে আছে। অথচ জীবনযাত্রার খরচের ঊর্ধ্বমুখী এ সময়ে তিনিও নিজের প্রয়োজনে বিনিয়োগের টাকার কোনো সুফল নিতে পারছেন না।

এই তো গেল বিনিয়োগকারীর দুর্দশার দিক। শেয়ারবাজারে লেনদেনের মধ্যস্থতাকারী ব্রোকারেজ হাউসগুলোর অবস্থা আরও করুণ। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শীর্ষস্থানীয় একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়রোজগারও তলানিতে ঠেকেছে। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাদের কেউ কেউ ভিন্ন পন্থা বেছে নিয়েছে।

কেউ কেউ কমিশন আয় ঠিক রাখতে ‘ব্লক মার্কেটকে’ ব্যবহার করছেন। তা–ও কৃত্রিমভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। লেনদেন বাড়িয়ে দেখাতে কিছু কিছু বিনিয়োগকারীর এক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব থেকে অন্য বিও হিসাবে শেয়ার স্থানান্তর করছে। এতে বাজারে লেনদেন বাড়ছে, ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের আয় বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত লেনদেন হচ্ছে না। এ কারণে বড় বিনিয়োগকারীদের অনেকে এখন ব্লক মার্কেটকে ব্যবহার করে শেয়ারের হাতবদল করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী জানান, ফ্লোর প্রাইস আরোপের আগে লেনদেনের কমিশন বাবদ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদিনের গড় আয় ছিল ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এখন তা কমে নেমে এসেছে ৮–১০ লাখ টাকায়। বাজারে লেনদেন যত কমে যায় ব্রোকারেজ হাউস ও স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনের কমিশন আয়ও তত কমে।

শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচা থেকে গড়ে ৩০ পয়সা কমিশন নেয় লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কমিশন আয়ও গড়ে ৫০–৬০ শতাংশ কমে গেছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারবাজারের বেশির ভাগ শেয়ারেরই এখন কোনো লেনদেন হচ্ছে না। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বাজারে লেনদেন হওয়া ৪০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬১টি বা প্রায় ৬৫ শতাংশেরই কোনো লেনদেন হয়নি।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছেন ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। বেশি লাভের আশায় ভালো শেয়ারে ঋণ করে বিনিয়োগ করে অনেকে আটকে আছেন। না পারছেন শেয়ার বিক্রি করতে, না পারছেন কিনতে। কিন্তু দিন শেষে ঘুরছে সুদের চাকা। তাতে বসে বসে সুদ গুনতে হচ্ছে এসব বিনিয়োগকারীকে।

শেয়ারবাজারে কার্যক্রম মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। তার একটি প্রাইমারি মার্কেট। অন্যটি সেকেন্ডারি মার্কেট। প্রাইমারি বাজারের মাধ্যমে মূলত নতুন কোম্পানিকে মূলধন জোগান দেওয়া হয়। আর সেকেন্ডারি বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির হাতবদল হয়। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কারণে প্রাইমারি মার্কেটের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহ কমেছে কোম্পানিগুলোর। কারণ, ব্যবসা–বাণিজ্যে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় ভালো কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে না। যেসব কোম্পানি বাজারে আসছে সেগুলোর মান নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। ফলে প্রাইমারি বাজারটিও খুব বেশি সক্রিয় নেই। বিনিয়োগকারীরাও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও শেয়ারে খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ কারণে সম্প্রতি আইপিওতে আসা একটি ব্যাংকের শেয়ারের আইপিওর বড় অংশই অবিক্রীত ছিল।

আর সেকেন্ডারি বাজারটির কার্যক্রমও ফ্লোর প্রাইসে বন্দী। এ অবস্থায় তাই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের মনে প্রশ্ন একটাই—কৃত্রিম এ শেয়ারবাজার কার কাজে লাগছে?

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারবাজার একটি ‘কৃত্রিম’ বাজারে রূপ নিয়েছে। বর্তমান এ বাজার কারোরই কোনো কাজে লাগছে না। উল্টো দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ, এ ধরনের বাজারে দেশি–বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবেন না, এটাই স্বাভাবিক। হচ্ছেও তা–ই।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, বিনিয়োগের জন্য মানুষ শেয়ারবাজারকে বেছে নেন মূলত ‘সহজে বিনিয়োগ ও সহজে বেরিয়ে যাওয়ার (ইজি এক্সেস ও ইজি এক্সিট)’ সুবিধার কারণে। সেই পথই বন্ধ করে দিয়েছে ফ্লোর প্রাইস। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির অধিকার ক্ষুণ্ন করছে এ ব্যবস্থা।