ডিএসইর প্রধান সূচকটি কমে গতকাল আবারও ২০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারও মূল্যসূচক ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যাওয়ার ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬ হাজার পয়েন্টের কাছাকাছি নেমে আসায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
ডিএসইএক্স গতকাল মঙ্গলবার ৫২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৭ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এটি গত ২০ মাসের মধ্যে ডিএসইএক্স সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৮ জুলাই এ সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমেছিল। আর তাই সূচকের পতন ঠেকাতে তিন দিন পর ৩১ জুলাই থেকে শেয়ারের দামের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর তথা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেটির কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার বা ইউনিট বেঁধে দেওয়া দামের নিচে নামতে পারে না। ২০২২ সালে এ ব্যবস্থা আরোপের ফলে শেয়ারবাজারে স্থবিরতা নেমে আসতে শুরু করে এবং লেনদেন কমে যায়। একপর্যায়ে অধিকাংশ শেয়ারের দাম কমে ফ্লোর প্রাইসে আটকে যায়। এসব কোম্পানির লেনদেন একপ্রকার বন্ধই হয়ে পড়ে। এতে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার দাবি ওঠে। এ অবস্থায় বাজারে গতি ফেরাতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করে নেয় বিএসইসি।
ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর তুলে নেওয়ার পর সার্বিক লেনদেন বৃদ্ধি পায় এবং সূচকের ওঠানামা দেখা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ডিএসইর প্রধান সূচক কমে আবারও ছয় হাজারের কাছাকাছি নেমে আসে। শেয়ারবাজারে সূচকের ছয় হাজার পয়েন্ট গত কয়েক বছরে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। অর্থাৎ এটি একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক সীমায়’ পরিণত হয়েছে। কারণ, সূচক যখনই ৬ হাজার পয়েন্টের আশপাশে নামে, তখনই বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পর্যন্ত সবার মধ্যেই একধরনের উদ্বেগ-আতঙ্ক তৈরি হয়, যা এখন দেখা দিয়েছে। আবার সূচক ৬ হাজার পয়েন্ট থেকে ওপরের দিকে ছুটলে অনেকেই আশাবাদী হয়ে ওঠেন। যদিও কয়েক দিন ধরে সূচক ও ফ্লোর প্রাইস নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এ ধরনের গুজব থেকে সতর্ক থাকার জন্য বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আমরা আশা করছি, বাজার শিগগিরই আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করলে দ্রুতই এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বাজার যাতে ঘুরে দাঁড়ায়, সে জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর কাজ করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মুখপাত্র, বিএসইসি
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সূচক ৬ হাজারের ওপরে গিয়ে আবার বাউন্স ব্যাক করছে। এতে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন। কিন্তু আমরা আশা করছি, বাজার শিগগিরই আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করলে দ্রুতই এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বাজার যাতে ঘুরে দাঁড়ায়, সে জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর কাজ করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।’
গত ১০ মার্চ বিএসইসি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস ও জেড শ্রেণির বিষয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় এ মুহূর্তে কমিশনের বিবেচনায় নেই। তাই এ ধরনের গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে বিএসইসি।
কেন শেয়ারবাজারে ৬ হাজার সূচককে কেন্দ্র করে বারবার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে, এমন প্রশ্ন করা হলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের শিক্ষক নিতাই চন্দ্র দেবনাথ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি বাজার যখন মৌলভিত্তি অনুযায়ী চলে না, তখন এ ধরনের পরিস্থিতিই তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শেয়ারবাজার হাতে গোনা কিছু খারাপ শেয়ারনির্ভর।’ কারসাজিকারকেরা কম দামের এসব খারাপ শেয়ার কিনে দিনের পর দিন অস্বাভাবিকভাবে সেগুলোর দাম বাড়িয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব শেয়ার ও কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। এ সুযোগে কারসাজিকারকেরা দাম বাড়িয়ে খারাপ শেয়ারগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা তুলে নিয়েছেন। অন্যদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ফলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
শেয়ারবাজারে গতকালও দেখা গেছে, ভালো মৌলভিত্তির বেশির ভাগ শেয়ারের দরপতন ঘটেছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে ভালো মৌলভিত্তির ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২১টিরই দরপতন হয়েছে। এই ৩০ কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে মাত্র ৪টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৫টির শেয়ারের দাম।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল ঢাকার বাজারে সূচকের পতনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বীকন ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, রেনেটা, ফরচুন শুজ, আফতাব অটো, উত্তরা ব্যাংক ও গ্রামীণফোনের মতো কোম্পানিগুলোর। এসব কোম্পানির শেয়ারের দরপতনে গতকাল ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে ২৬ পয়েন্টের বেশি।
ঢাকার বাজারে গতকাল ৩৯৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে আগের চেয়ে ৭৭ শতাংশ বা ৩০৮টিরই দাম কমেছে। আর বেড়েছে ৪৫টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৪৫টির শেয়ারদর। বেশির ভাগ শেয়ারের দরপতনের ফলে লেনদেনও আগের দিনের তুলনায় ২৫ শতাংশ কমেছে। গতকাল দিন শেষে ডিএসইতে লেনদেন হয় ৫৬৪ কোটি টাকার শেয়ার, যা আগের দিনের চেয়ে ১৯০ কোটি টাকা কম।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক নিতাই চন্দ্র দেবনাথ মনে করেন, কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাজারের এ পরিণতি হতো না। বাজারে মৌলিক যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলোকে আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে বারবার কারসাজির সুযোগ দিয়ে বাজার ঠিক করা যাবে না।