দুই ব্যাংকের আইপিওতে লোকসান, মিডল্যান্ড ব্যাংকে তাই অনাগ্রহ

গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

শেয়ারবাজারে ব্যাংকের শেয়ারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে বাজারে নতুন তালিকাভুক্ত হওয়া ব্যাংকের শেয়ারেরও ক্রেতা নেই। এ কারণে গত বছর তালিকাভুক্ত হওয়া দুটি ব্যাংকের শেয়ারের দামও দীর্ঘদিন ধরে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে।

আর ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের চরম আস্থাহীনতার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বেসরকারি খাতের মিডল্যান্ড ব্যাংকের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও শেয়ারে। ব্যাংকটির প্রায় ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকার আইপিও শেয়ার অবিক্রীত ছিল।

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকটির শেয়ার কিনতে আবেদন না করায় এ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। ফলে নিয়ম অনুযায়ী অবিক্রীত এসব আইপিও শেয়ার এখন কিনতে হচ্ছে পাঁচটি অবলেখনকারী বা আন্ডাররাইটার প্রতিষ্ঠানকে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী মিলিয়ে মিডল্যান্ডের ব্যাংকের আইপিওতে যে বরাদ্দ ছিল তার চেয়ে কম শেয়ার কেনার জন্য আবেদন জমা পড়ে।

সব মিলিয়ে মিডল্যান্ড ব্যাংকের আইপিওটি ছিল ৭০ কোটি টাকা দামের ৭ কোটি শেয়ার। সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে এসব শেয়ার বিক্রির জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তার মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আবেদন কম পড়ায় ব্যাংকটির ১৮ কোটি ১৪ লাখ শেয়ার অবিক্রীত থাকে।
মিডল্যান্ড ব্যাংকের অবিক্রীত আইপিও শেয়ার নিয়ম অনুযায়ী অবলেখনকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। পনের দিনের মধ্যে এসব শেয়ার বণ্টনের বিধান রয়েছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেই প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পন্ন করে ব্যাংকটির আইপিও কার্যক্রম শেষে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ইফতেখার আলম, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে ৬৫ কোটি টাকা দামের শেয়ার বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকার। তবে তার বিপরীতে জমা পড়ে ১৫ কোটি ৬ লাখ টাকার আবেদন। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৬ কোটি ২৫ লাখ টাকার শেয়ার। তার বিপরীতে জমা পড়ে ৩১ কোটি ৮০ লাখ টাকার আবেদন। এ ছাড়া ৫ কোটি টাকার শেয়ার ব্যাংকটির কর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়।

সব মিলিয়ে মিডল্যান্ড ব্যাংকের আইপিওটি ছিল ৭০ কোটি টাকা দামের ৭ কোটি শেয়ার। সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে এসব শেয়ার বিক্রির জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তার মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আবেদন কম পড়ায় ব্যাংকটির ১৮ কোটি ১৪ লাখ শেয়ার অবিক্রীত থাকে।

অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটেছিল গত বছরের অক্টোবরে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (জিআইবি) আইপিওর ক্ষেত্রেও। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩৪৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা দামের শেয়ার বিক্রির জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু তাদের কাছ থেকে ওই সময় জমা পড়ে ১৯২ কোটি ৬৭ লাখ টাকার আবেদন। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ করা প্রায় ১৫৩ কোটি টাকার শেয়ার অবিক্রীত ছিল। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বাড়তি আবেদন জমা পড়ায় শেষ পর্যন্ত জিআইবির কোনো প্রাথমিক শেয়ার অবিক্রীত ছিল না।

বিএসইসির নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশ মিলিয়ে আইপিওর শেয়ারের অবিক্রীত অংশের হিসাব করা হয়। তাই দুই অংশের জন্য বরাদ্দ করা শেয়ার সম্মিলিতভাবে বিক্রি হয়ে গেলে সে ক্ষেত্রে ওই আইপিও শেয়ার অবিক্রীত থাকে না। এ কারণে জিআইবির আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা শেয়ার বিক্রি না হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বাড়তি আবেদন পড়ায় অবিক্রীত অংশ তাদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

তবে মিডল্যান্ড ব্যাংকের ক্ষেত্রে ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী মিলিয়েও বরাদ্দ করা সব শেয়ার বিক্রি করা যায়নি। ফলে এটির আইপিওর একটি অংশ অবিক্রীত রয়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মিডল্যান্ড ব্যাংকের আইপিওর আবেদন শেষ হয়েছে।

আইপিও আবেদন শেষ হওয়ার পর মিডল্যান্ড ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকার শেয়ার অবিক্রীত থাকায় সেগুলো এখন নিয়ম অনুযায়ী অবলেখনকারীদের কিনে নিতে হবে। ব্যাংকটির আইপিওর অবলেখনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে পাঁচটি মার্চেন্ট ব্যাংক। এগুলো হলো প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট, রূপালী ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রূপালী ইনভেস্টমেন্ট, সোনালী ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সোনালী ইনভেস্টমেন্ট, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবি এবং লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্ট।

বাজারের সাম্প্রতিক মন্দাভাবের কারণেও বিনিয়োগকারীরা আইপিও শেয়ারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইপিও প্রসপেক্টাসের বিধান অনুযায়ী, মিডল্যান্ডের অবিক্রীত শেয়ারের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার শেয়ার কিনতে হবে লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্টকে। আর আইসিবিকে কিনতে হবে ২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার শেয়ার। এ ছাড়া অন্য তিনটি মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রতিটিকে কিনতে হবে ১ কোটি ৪৮ টাকার সমমূল্যের শেয়ার।

মিডল্যান্ড ব্যাংকের আইপিওর ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্ট। আর আগে জিআইবির আইপিওরও ইস্যু ব্যবস্থাপনার কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আলম প্রথম আলোকে বলেন, মিডল্যান্ড ব্যাংকের অবিক্রীত আইপিও শেয়ার নিয়ম অনুযায়ী অবলেখনকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। পনের দিনের মধ্যে এসব শেয়ার বণ্টনের বিধান রয়েছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেই প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পন্ন করে ব্যাংকটির আইপিও কার্যক্রম শেষে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এর আগে তালিকাভুক্ত হওয়া দুটি ব্যাংকের আইপিওতে ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। ব্যাংক দুটির শেয়ারের দাম তালিকাভুক্তির পরপরই ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে যায়। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকগুলোর আইপিও শেয়ার কিনে লোকসানের মুখে পড়েন।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

কেন ব্যাংকের আইপিওতে অনাগ্রহ

গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারে আসা ব্যাংকসহ একাধিক কোম্পানির ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তারা জানান, এমনিতেই বাজারে দীর্ঘদিন ধরে মন্দাভাব চলছে। তার মধ্যে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে তলানিতে।
তাঁরা বলেন, আইপিও আবেদনে লটারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর থেকে ব্যাংকের আইপিওতে আবেদনের ক্ষেত্রে আরও বেশি ভাটা পড়েছে। কারণ, গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে একমাত্র এনআরবি কমার্শিয়াল বা এনআরবিসি ব্যাংক ছাড়া কোনোটিরই আইপিও শেয়ার থেকে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা পাননি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

তাঁরা আরও জানান, এনআরবিসি ব্যাংক তালিকাভুক্ত হওয়ার পর সেটির শেয়ার নিয়ে বড় ধরনের কারসাজি হয়। তাতে হু হু করে বেড়েছিল ব্যাংকটির শেয়ারের দাম। তাতে আইপিও শেয়ার বিক্রি করে ভালো মুনাফা পেয়েছিল বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এরপর তালিকাভুক্ত হওয়া অন্য কোনো ব্যাংকে সেটি হয়নি। তাই ব্যাংকের আইপিওতে আবেদনের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বিনিয়োগকারীরা।

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সর্বশেষ গত ১৬ নভেম্বর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন শুরু হয় ৯ টাকায়। অথচ আইপিওতে ব্যাংকটির প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল ১০ টাকায়। ফলে এ ব্যাংকের আইপিওর শেয়ারে বিনিয়োগ করে বাজার থেকে কোনো মুনাফা করতে পারেনি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এ ছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের সাতটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুর নিচে। বাজারেই যেখানে একাধিক ব্যাংকের শেয়ার ফেসভ্যালুর কমে কেনার সুযোগ রয়েছে, সেখানে বিনিয়োগকারীরা ১০ টাকা দামে আইপিও শেয়ার কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এসব কারণে ব্যাংকের আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে তালিকাভুক্ত হওয়া দুটি ব্যাংকের আইপিওতে ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। ব্যাংক দুটির শেয়ারের দাম তালিকাভুক্তির পরপরই ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে যায়। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকগুলোর আইপিও শেয়ার কিনে লোকসানের মুখে পড়েন।

এ কারণে মিডল্যান্ড ব্যাংকের আইপিওতে আবেদনের ক্ষেত্রে তাঁরা অনাগ্রহ দেখিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংকের অবস্থান অনেকের তুলনায় ভালো এ কথা উল্লেখ করে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, বাজারের সাম্প্রতিক মন্দাভাবের কারণেও বিনিয়োগকারীরা আইপিও শেয়ারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।