কোম্পানির মুনাফায় ধাক্কা, শেয়ারবাজারে সংকট বাড়াবে কি

গত সপ্তাহে প্রকাশিত ২৮ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৮টিরই মুনাফা কমেছে। আর মুনাফা বেড়েছে শুধু ১০টি কোম্পানির।

ইলেকট্রনিক খাতের দেশীয় কোম্পানি ওয়ালটনের মুনাফায় বড় ধরনের ধস নেমেছে গত বছরের শেষার্ধে। বিদায়ী ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালে কোম্পানিটির মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩২ কোটি টাকা বা ৯৭ শতাংশ কমেছে। মুনাফায় এ ধস নামা ও বিক্রি কমা এবং ডলারের বাড়তি দামের কারণে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন হয়েছে।

ওয়ালটন জুলাই-ডিসেম্বরের যে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের শেষ ছয় মাসে কোম্পানিটির বিক্রি আগের বছরের চেয়ে ৫৬৬ কোটি টাকা বা ১৮ শতাংশ কমেছে। এটি হয়েছে মূলত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মানুষ অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দেওয়ায়। আলোচ্য সময়ে ওয়ালটন ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনে ওয়ালটন বলেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে সংকট চলছে। তাতে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ ছাড়া জাহাজভাড়া ও টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে কোম্পানির বিক্রি ও মুনাফা কমেছে।

‘কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার–সংকটের কারণে আমাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছিল। এতেই মূলত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আয় হয়েছে। তাতে মুনাফাও বেড়েছে। তবে পরিমাণের দিক থেকে বিক্রি খুব বেশি বাড়েনি।’
মো. গোলাম মোস্তফা, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের চিফ ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার

গত বছরের শেষ ছয় মাসে শুধু ডলারের বাড়তি দামের কারণেই ৩৩৬ কোটি টাকা মুনাফা হারিয়েছে কোম্পানিটি। এর ফলে তাদের শেয়ারপ্রতি আয়  উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের ব্যাংক খাত ও অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা শেয়ারবাজারের কোম্পানিগুলোর মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে বেশির ভাগ কোম্পানির হয় মুনাফা কমেছে, নয়তো লোকসান হয়েছে।

এ অবস্থায় শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় আছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কারণ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফা কমলে বা লোকসান হলে তার নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই শেয়ারের দামে পড়ে। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে শেয়ারবাজারে মন্দাভাব চলছে। তাই তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন শেয়ারবাজারে আরও বেশি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৩২টি গত এক সপ্তাহে তাদের অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে চারটি কোম্পানির প্রতিবেদন সাপ্তাহিক ছুটির থাকায় স্টক এক্সচেঞ্জ ও কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি। বাকি ২৮টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৮টিরই মুনাফা কমেছে। বাকি ১০টির মুনাফা বেড়েছে।

বাজার যদি স্বাভাবিক আচরণ করে, তাহলে কোম্পানির মুনাফা কমলে তার নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই শেয়ারের দামে পড়বে। তবে দীর্ঘদিন কোম্পানিগুলো লোকসান বইবে না।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান

যেসব কোম্পানির মুনাফা কমেছে, তার সিংহভাগই উৎপাদন খাতের। যেসব কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ তথ্যপ্রযুক্তি ও সেবা খাতের। একাধিক কোম্পানির শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে, সেগুলোকেও কমবেশি বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা হয় খরচ কমিয়ে, না হয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা ধরে রেখেছে।

দাম বাড়িয়ে মুনাফায় সফল যারা 

বহুজাতিক কোম্পানি বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ গত বছরের ৯ মাসে রাজস্ব আয়ে রেকর্ড করেছে। গত এপ্রিল-ডিসেম্বরে কোম্পানিটি ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে, যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭৬ কোটি টাকা বা ১৭ শতাংশের বেশি। মূল ব্যবসা থেকে কোম্পানিটির মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৮৮ কোটি টাকা। ফলে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইউপিএস বেড়ে হয়েছে ৪৩ টাকা ২৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪১ টাকা ৩৪ পয়সা।

কোম্পানিটি জানায়, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ১১২ কোটি টাকা মুনাফা হারিয়েছে তারা। তা সত্ত্বেও তাদের মুনাফা আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। এ নিয়ে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের চিফ ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার মো. গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার–সংকটের কারণে আমাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছিল। এতেই মূলত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আয় হয়েছে। তাতে মুনাফাও বেড়েছে। তবে পরিমাণের দিক থেকে বিক্রি খুব বেশি বাড়েনি।’

অন্যদিকে খরচ কমিয়ে ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা বাড়িয়েছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ। কোম্পানিটি বিপণন খরচ ২৩ কোটি টাকা কমিয়েছে। গত বছরের এপ্রিল-ডিসেম্বর সময়ে কোম্পানিটি বিপণন বাবদ খরচ করেছে ৭৬ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে খরচ করেছিল প্রায় ৯৯ কোটি টাকা। কোম্পানিটি আগের বছরের তুলনায় ৮৩ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে। 

মুনাফা খেয়ে ফেলেছে ডলারের দাম

ক্রাউন সিমেন্ট গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা আয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫৮ কোটি টাকা বা সাড়ে ২৯ শতাংশ বেশি। কোম্পানিটি বলছে, সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধি ও বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধির কারণেই বাড়তি আয় হয়েছে। তারপরও সিমেন্ট খাতের এ কোম্পানির মুনাফা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা কম হয়েছে। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ডলারের বাড়তি দামই ছিল মুনাফা কমার বড় কারণ।

ক্রাউন সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, ডলারের বাড়তি দামের কারণে তারা ৬১ কোটি টাকা মুনাফা হারিয়েছে। এ ছাড়া ডলারের বাড়তি দামের কারণে কোম্পানিটির বিদেশি ঋণ পরিশোধে সুদবাবদ খরচ বেড়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। বিক্রি ও সিমেন্টের দাম বাড়িয়েও মুনাফা বাড়াতে পারেনি কোম্পানিটি।

জানতে চাইলে ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিমেন্ট শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও জাহাজ খরচ বেড়ে যাওয়ার পরও আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিট মুনাফা কমে গেছে ডলারের বাড়তি দামের প্রভাবের কারণে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় গত বছরের শেষ ছয় মাসে আমাদের ৭৫ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে। ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকলে আমরা ভালো মুনাফা করতে পারতাম।’

শেয়ারবাজারে প্রভাব কী

শেয়ারের দামের ওঠানামা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফায় বড় ভূমিকা রাখে। সে অনুযায়ী যে কোম্পানি যত বেশি মুনাফা করবে, সেটির শেয়ারের দামও তত বাড়বে। এটিই শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক প্রবণতা। তবে কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও ঘটে। কিন্তু স্বাভাবিক প্রবণতাকে বিবেচনায় নিলে বলা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো লাভ-লোকসানের যে হিসাব দিচ্ছে, তা শেয়ারবাজারের জন্য মোটেও সুখকর নয়।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বাজার যদি স্বাভাবিক আচরণ করে, তাহলে কোম্পানির মুনাফা কমলে তার নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই শেয়ারের দামে পড়বে। তবে দীর্ঘদিন কোম্পানিগুলো লোকসান বইবে না। একপর্যায়ে গিয়ে তারা মুনাফায় ফিরতে পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দেবে। তখন কোম্পানিগুলো হয়তো লাভে ফিরবে। তাই কোম্পানির মুনাফা কমায় সাময়িকভাবে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এ অবস্থা থাকবে না। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আগ্রহী হতে হবে।

মুনাফা কম-বেশির কী প্রভাব শেয়ারের দামে

গত এক সপ্তাহে প্রকাশিত ২৮টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আবাসন খাতের কোম্পানি ইস্টার্ন হাউজিং, টেলিকম খাতের এডিএন টেলিকম ও হোটেল খাতের ইউনিক হোটেলের মুনাফা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। গত কয়েক দিনে তার প্রভাব দেখা গেছে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামে। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ারের দাম তিন কার্যদিবসে প্রায় ১৯ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ টাকা। একই সময়ে ইউনিক হোটেলের শেয়ারের দাম সাড়ে ৬ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ টাকা ৩০ পয়সায়, আর এডিএন টেলিকমের শেয়ার ৮ টাকা বেড়ে ১২১ টাকায় উঠেছে।

ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে দাম

শেয়ারবাজারে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারই এখন সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। ফলে মুনাফা কমে যাওয়া বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দামে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। ওয়ালটন, আইসিবি, আরএকে সিরামিকস, সিঙ্গার বাংলাদেশের মতো ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমলেও তাদের শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। ফলে মুনাফা কমার প্রভাব এসব শেয়ারে পড়েনি। তাতে অবশ্য বাজার রক্ষা পেয়েছে নেতিবাচক প্রভাব থেকে। 

ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা

চলতি মাসে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সব ধরনের শিল্পের জন্য গ্যাসের ইউনিটপ্রতি দাম বেড়ে হবে ৩০ টাকা। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্যাসের নতুন দাম কার্যকর হলে আরেক দফা ধাক্কা লাগবে শেয়ারবাজারের কোম্পানিগুলোর ওপর।

বিশেষ করে বস্ত্র খাতসহ উৎপাদন খাতের গ্যাসনির্ভর কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে যাবে। তাতে নতুন করে আরও অনেক কোম্পানির মুনাফা কমে যেতে পারে। সেটি হলে বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ফলে বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি শেয়ারবাজার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও। এ কারণে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই ফ্লোর প্রাইস না তোলার সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থান নিয়েছে সংস্থাটি।