মন্দাভাব চলছে এখন শেয়ারবাজারে। লেনদেন নেমেছে তলানিতে। তাতে বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে গেছে বাজারে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী থেকে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারী—সবার মধ্যেই এখন দুশ্চিন্তা। বাজারের এ অবস্থায় কি করবেন—সবার মধ্যেই যেন একই প্রশ্ন। তবে বিশ্লেষকেরা বলেন, মন্দাবাজারও কখনো কখনো নতুন সুযোগ তৈরি করে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। এমনিতেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা যার যত বেশি, লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও তার তত বেশি। তবে ঝুঁকি নিতে হবে সব সময় বুঝেশুনে।
বর্তমানে শেয়ারবাজার আটকে আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইসে। বাজারের পতন ঠেকাতে গত জুলাইয়ে এ ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা এরই মধ্যে একাধিক আলোচনায় জানিয়েছেন, আপাতত ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার কথা ভাবছেন না তারা। কারণ, এখনই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি আরও কিছুদিন ফ্লোর প্রাইস আরোপিত থাকে, তাহলে কি বাজার বন্ধ হয়ে যাবে? এ প্রশ্নের অবশ্য নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই। কারণ, বাজার পরিচালিত হয় ক্রেতা-বিক্রেতার অংশগ্রহণে। যদি ক্রেতারা সক্রিয় হন, তাহলে বাজারে চাহিদা বাড়বে। আর ক্রেতারা নিষ্ক্রিয় থাকলে, বাজারে লেনদেন থমকে যাবে। সুতরাং, ক্রেতা হিসেবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা-অনাস্থার ওপরই নির্ভর করছে বাজারের ভবিষ্যৎ।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে খুব বেশি শেয়ারের লেনদেন হচ্ছে না। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে বাজারের জন্য উদ্বেগজনক। বেশির ভাগ শেয়ারের লেনদেন না হওয়ায় সার্বিকভাবে লেনদেনও তলানিতে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় লেনদেন বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে। তেমনই একটি উদ্যোগ—ফ্লোর প্রাইসের চেয়ে ১০ শতাংশ কমে ব্লক মার্কেটে লেনদেনের সুযোগ তৈরি করা। এটি করা হয়েছে মূলত কিছু কিছু শেয়ারের লেনদেন বাড়াতে।
বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এখন ব্লক মার্কেটে বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেনের এ সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের লক্ষ্য থেকেই তারা কাজটি করছেন বলে জানান একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিসহ বেশ কিছু মৌলভিত্তির শেয়ার রয়েছে, যেগুলো বছর শেষে ভালো লভ্যাংশ দেয়। আবার অর্থনীতির এ সংকটকালেও অনেক কোম্পানি ভালো ব্যবসা করছে। ফলে এসব শেয়ারের ভবিষ্যৎও ভালো। তাই এখন তারা কম দামে এ ধরনের ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন। তাঁদের আশা, বাজার স্বাভাবিক ধারায় ফিরলে এসব শেয়ারের দামও বাড়বে। তখন হয়তো ভালো মুনাফা পাবেন তাঁরা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্লক মার্কেটে ফ্লোর প্রাইসের চেয়ে কম দামে শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ কি ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পাবেন? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। তবে এ ক্ষেত্রে মানতে হবে ন্যূনতম বিনিয়োগের শর্ত। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে ব্লক মার্কেটে লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সীমা পাঁচ লাখ টাকা। অর্থাৎ, একজন বিনিয়োগকারী ব্লক মার্কেট থেকে কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনতে চাইলে তাঁকে বাজারমূল্যে ওই কোম্পানির ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকার সমপরিমাণ শেয়ার কিনতে হবে। তবে চাইলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মূল বাজারের মতো স্বাভাবিকভাবে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারবেন না। ব্লক মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের সহায়তা নিতে হবে। ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোই মূলত এ বাজারে কেনাবেচার তথ্য রাখেন।
সাধারণ বাজারের চেয়ে ব্লক মার্কেটে লেনদেনের ভিন্নতা হলো সাধারণত ব্লক মার্কেটে শেয়ারের ক্রেতা-বিক্রেতা ও দাম আগেই ঠিক করা হয়ে থাকে। শুধু ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো এ ধরনের কেনাবেচার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে।
মন্দাবাজারে এ তো গেল কম দামে শেয়ার কেনাবেচার একটি সুযোগের কথা। এ ছাড়া এ সময়ে আর কী কী করতে পারেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। যদিও বর্তমান বাস্তবতায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য লেনদেনের সুযোগ খুবই সীমিত। কারণ, বাজারে লেনদেন এখন হাতে গোনা কিছু কোম্পানির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে। একটি ঋণ ছাড়া নিজের সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ করেন। অন্যটি নিজের সঞ্চয়ের টাকার পাশাপাশি ঋণ নিয়েও বিনিয়োগ করেন। বর্তমান বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। কারণ, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বেশির ভাগ শেয়ারের লেনদেন কার্যত বন্ধ থাকলেও তাদের গুনতে হচ্ছে নিয়মিত ঋণের সুদ। তাতে প্রতিদিন ভারী হচ্ছে লোকসানের পাল্লা। এ অবস্থায় ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা যেটি করতে পারেন, সেটি হলো ঋণমুক্ত হওয়ার চেষ্টা। সেটি দুভাবে করা যেতে পারে। প্রথমত, হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে ঋণ সমন্বয়। দ্বিতীয়টি নতুন করে বিনিয়োগ করে ঋণ সমন্বয় করা। ঋণমুক্ত হলে তাতে সুদ নিয়ে দুশ্চিন্তা অন্তত কমবে।
আর যাঁরা ঋণ ছাড়া নিজের সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা চাইলে এ সময়ে নতুন করে কিছু অর্থ বিনিয়োগ করে শেয়ারের ক্রয়মূল্য সমন্বয় করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে এখানে বলা যেতে পারে, ধরা যাক আপনি ১০০ টাকায় কোনো একটি কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। সেটির বাজারমূল্য এখন ৮০ টাকা ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। সে ক্ষেত্রে আপনি নতুন করে ওই শেয়ারে কিছু অর্থ বিনিয়োগ করলে তাতে আপনার গড় ক্রয়মূল্য কমে আসবে। আর যখন দাম বাড়তে শুরু করবে তখন হয়তো দ্রুত আপনি ওই শেয়ারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। তবে এ ধরনের বিনিয়োগের আগে সবার আগে যেটি বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা, লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা বা অতীত ইতিহাস ও ব্যবসার সম্ভাবনার দিকটি। সহজ করে বললে, কেবল ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারেই ক্রয়মূল্য সমন্বয় করলে তাতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। খারাপ শেয়ারে নতুন বিনিয়োগ করে ক্রয়মূল্য সমন্বয় করা হলে তাতে লোকসান বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।