চলতি অর্থবছর শেষ হতে আর মাত্র তিন মাস বাকি আছে। আপনি যদি আয় করেন এবং আপনার এই আয় যদি করযোগ্য হয়, তাহলে চলতি বাজেটে দেওয়া সুবিধার সুযোগ নিয়ে আপনি কর কমানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। বিদ্যমান নিয়মকানুনে আপনি যদি করের পরিমাণ কমাতে চান, তাহলে এখনই পরিকল্পনা করুন।
আপনি হয়তো জানেন, আপনার আয়ের একটি অংশ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করলে কর ছাড় পাওয়া যায়। তবে চলতি অর্থবছরের বাকি থাকা তিন মাসের মধ্যে, অর্থাৎ জুন মাসের মধ্যেই বিনিয়োগ করতে হবে।
কারণ, প্রতিবছর জুলাই থেকে পরের বছরের জুন মাস—১২ মাসের আয়ের ওপর কর বসে। এই সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ করে কর রেয়াত নিতে হয়। প্রতিবছর বার্ষিক আয়–ব্যয়ের বিবরণী বা রিটার্ন জমার সময় বিনিয়োগের তথ্য দিয়ে কর কমাতে হয়।
আগামী জুলাইয়ে শুরু হবে নতুন অর্থবছর। বিভিন্ন করের প্রস্তাব করে অর্থমন্ত্রী সেই বছরের জন্য একটি নতুন বাজেট পেশ করবেন। করের বিভিন্ন নিয়মকানুন তখন হয়তো বদলে যেতে পারে।
তবে এর আগেই দেখে নিন কোথায় বিনিয়োগ করলে বছর শেষে কর কমানো যেতে পারে।
কর কমানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় খাত হলো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। সঞ্চয়পত্রে নির্দিষ্ট হারে বিনিয়োগ করলে আপনার আয়কর কমে যাবে। কর রেয়াত পেতে আপনি আপনার বার্ষিক আয়ের ২০ শতাংশ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। তাহলে আপনার যত কর হবে, এর ১৫ শতাংশ মওকুফ হবে।
এ ছাড়া শেয়ারবাজারে টাকা খাঁটিয়েও কর রেয়াত পাওয়া যাবে। শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার কিনলেও তা বিনিয়োগ হিসেবে ধরবেন কর কর্মকর্তারা। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেও একই সুবিধা মিলবে।
অনেকে ডিপোজিট পেনশন স্কিম বা ডিপিএস করেন। প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিপিএস করলে, অর্থাৎ বছরে ৬০ হাজার পর্যন্ত টাকা রাখলেও তা কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে। এর মানে, ডিপিএস করাকেও একধরনের বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
সঞ্চয়পত্র, শেয়ারবাজার, ডিপিএসসহ মোট নয়টি খাতে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত মিলবে।
অন্য যে ছয় খাতে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত মিলবে, সেগুলো হলো জীবনবিমার প্রিমিয়াম; সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে চাঁদা; স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলে নিয়োগকর্তা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাঁদা; কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠী বিমার তহবিলে চাঁদা; সরকার অনুমোদিত ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ এবং সুপার অ্যানুয়েশন ফান্ডে চাঁদা।
হঠাৎ মৃত্যু হলে পরিবার যাতে আর্থিক সুবিধা পায়, সে জন্য অনেকে জীবনবিমা করে প্রতি মাসে প্রিমিয়াম দেন। সেই প্রিমিয়ামের টাকা বিনিয়োগ হিসেবে ধরে কর রেয়াত নিতে পারবেন করদাতারা। আবার চাকরিজীবীরা প্রতি মাসে প্রভিডেন্ট ফান্ডে চাঁদা, স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা দেন।
এই চাঁদা দিয়েও কর রেয়াত নেওয়া যাবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন থেকে অনেক সময় গোষ্ঠী বিমার চাঁদা কেটে রাখা হয়। সেই চাঁদাও বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে এসব চাঁদার পুরোটাই বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। এসব কর রেয়াত সুবিধা নিতে হলে রিটার্নের সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে যাবতীয় দলিল দিতে হবে।
এ বিষয়ে এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আয়ের একটা অংশ বিনিয়োগ করলে তা করদাতার জন্য শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। এই বিনিয়োগ তাঁকে পরবর্তী সময়ে যেকোনো বিপদ–আপদে আর্থিক সুরক্ষা দেবে। তাই সঞ্চয় বা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে এনবিআর এই কর ছাড় দেয়। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক করদাতা এই সুযোগ নিয়ে রিটার্নে কর কমান।
আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কর রেয়াত পেতে কোনো করদাতার বার্ষিক মোট আয়ের ২০ শতাংশ বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন। এর বেশি বিনিয়োগ করলে বাকি অর্থের ওপর কর ছাড় মিলবে না। তারপর ওই বছর আপনি যত টাকা বিনিয়োগ (রেয়াতসীমার মধ্যে) করেছেন, এর ১৫ শতাংশ পরিমাণ টাকা কর রেয়াত পাবেন।
একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন গোলাম মোস্তফা নামের এক চাকরিজীবী এক করবর্ষে (জুলাই-জুন) ১০ লাখ টাকা আয় করলেন। এর মধ্যে তিনি আয়ের ২০ শতাংশ বা ২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনলেন। সে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর প্রদেয় করের ওপর ছাড় পাবেন।
আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী গোলাম মোস্তফার হিসাবটি হবে এমন, গোলাম মোস্তফার ১০ লাখ টাকার আয়ের মধ্যে ৩ লাখ টাকার ওপর কর নেই। কারণ, দেশে এখন তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। গোলাম মোস্তফার করযোগ্য আয় হলো বাকি সাত লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম এক লাখ টাকার ওপর কর বসবে ৫ শতাংশ। এর মানে, এই স্তরে করের পরিমাণ ৫ হাজার টাকা।
বাকি ছয় লাখ টাকার মধ্যে তিন লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর বসবে। করের পরিমাণ হবে ৩০ হাজার টাকা। কর আরোপের পরবর্তী স্তরের বাকি তিন লাখ টাকার ওপর কর বসবে ১৫ শতাংশ হারে। করের পরিমাণ হবে ৪৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে গোলাম মোস্তফার প্রযোজ্য কর দাঁড়াবে ৮০ হাজার টাকা।
গোলাম মোস্তফার জন্য স্বস্তির বিষয় হলো তাঁকে ৮০ হাজার টাকা কর দিতে হবে না। কারণ, তিনি দুই লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। ১৫ শতাংশ হারে তিনি ৩০ হাজার টাকা কর রেয়াত পাবেন। তার করের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা। তিনি বিনিয়োগ না করলে তাঁকে ৮০ হাজার টাকাই কর দিতে হতো।
শুধু বিনিয়োগ নয়, সরকার নির্ধারিত কিছু খাতে দান করলেও একই হারে কর রেয়াত পাওয়া যায়। এমন ১৩টি দানের খাত আছে। এগুলো হলো জাতির জনকের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান; জাকাত তহবিল; জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুমোদিত দাতব্য হাসপাতাল; প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান; মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক; আহছানিয়া ক্যানসার হাসপাতাল; ঢাকা আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল; এশিয়াটিক সোসাইটি; আইসিডিডিআরবি; সিআরপি; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান এবং সরকার অনুমোদিত জনকল্যাণমূলক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর বাইরে অন্য কোথাও দান করলে কর ছাড় মিলবে না।
ধরুন, আপনি ঢাকা আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালে ৫০ হাজার টাকা দান করলেন। এই টাকার পুরোটাই আপনি কর রেয়াত পাবেন, যদি তা আপনার মোট আয়ের ২০ শতাংশের কম হয়। এভাবে দানের ১৩টি খাতের সব কটিতেই দান করে কর রেয়াত নেওয়া যাবে।
তবে অনেক সময় কিছু কিছু খাতে সরকার বিশেষ প্রজ্ঞাপন দিয়ে দানকে করমুক্ত ঘোষণা করে। তখন দানের অর্থ বাদ দিয়ে বাকি টাকার ওপর করারোপ হয়। সাধারণত দুর্যোগের সময় সরকার নির্ধারিত তহবিলে দানকে এভাবে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়।