চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ বিতরণে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন। এ বছর কোম্পানিটি শেয়ারধারীদের মধ্যে ৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছর ও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মুনাফার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশ হিসেবে এই অর্থ দিয়েছে গ্রামীণফোন। তাতে নগদ লভ্যাংশ বিতরণের দিক থেকে শীর্ষস্থানে রয়েছে এই মুঠোফোন কোম্পানি।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে গ্রামীণফোন তালিকাভুক্ত হয় ২০০৯ সালে। কোম্পানিটির ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। বাকি ৯০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। সেই হিসাবে গ্রামীণফোন এ বছর বিতরণ করা লভ্যাংশের মধ্যে ৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা পেয়েছেন কোম্পানিটির বিদেশি মালিকেরা। আর বাকি প্রায় ৩৮৫ কোটি টাকা পেয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
লভ্যাংশ বিতরণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আরেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ বা বিএটিবি। প্রতিষ্ঠানটি এ বছর চূড়ান্ত ও অন্তর্বর্তীকালীন নগদ লভ্যাংশ মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বিতরণ করবে, যার মধ্যে ৯৮৫ কোটি টাকা পাবেন কোম্পানির বিদেশি মালিকেরা। কারণ, এটির শেয়ারের প্রায় ৭৩ শতাংশই রয়েছে এই মালিকদের হাতে। বাকি ২৭ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। সেই হিসাবে তাঁরা পাবেন ৩৬৫ কোটি টাকা। কোম্পানি-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঘোষিত লভ্যাংশের একটি অংশ এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি অংশ চলতি বছরের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
দুই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পর নগদ লভ্যাংশ বিতরণে এ বছর তৃতীয় শীর্ষ স্থানে জায়গা করে নিয়েছে দেশের কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। কোম্পানিটি গত জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরের জন্য রেকর্ড ১১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাতে লভ্যাংশ বাবদ কোম্পানিটিকে বিতরণ করতে হবে ৯৭৫ কোটি টাকা, যার সিংহভাগ অর্থই পাবেন দেশি-বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কারণ, কোম্পানিটির শেয়ারের সাড়ে ৬৫ শতাংশই রয়েছে এসব বিনিয়োগকারীর হাতে। তাঁরা পাবেন প্রায় ৬২৯ কোটি টাকা। বাকি ৩৪৬ কোটি টাকা পাবেন কোম্পানিটির উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে লভ্যাংশের এই অর্থ হাতে পাবেন শেয়ারধারীরা।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক কোম্পানি আর্থিক হিসাব বছর শেষে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাদের মধ্যে বড় অংশই শেয়ারধারীদের জন্য নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করেছে। কিছু কোম্পানি লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আর কিছু কোম্পানি নগদ ও বোনাস উভয় লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যেসব কোম্পানি নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তারা শেয়ারধারীদের মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ করবে। আর বোনাস লভ্যাংশের ক্ষেত্রে দেওয়া হবে শেয়ার। এই প্রতিবেদনে যেসব কোম্পানি নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে, সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে টাকার অঙ্কে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানির তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় থাকা শীর্ষ ১০ কোম্পানি মিলে এ বছর শেয়ারধারীদের মধ্যে মোট ৯ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা বিতরণ করবে। এই অর্থের একটি অংশ এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে, বাকি অর্থ চলতি বছরের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
প্রথম আলোর এই তালিকার শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে সাতটিই বহুজাতিক তথা বিদেশি কোম্পানি। বাকি তিনটি দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানি। কোম্পানিগুলোর ঘোষিত লভ্যাংশের বড় অংশই পাবেন উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা। কারণ, তাঁদের হাতেই সবচেয়ে বেশি শেয়ার। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু স্কয়ার ফার্মা। কোম্পানিটির বিতরণ করা লভ্যাংশের সিংহভাগই পাবেন সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। কারণ, তাঁদের হাতেই কোম্পানিটির বেশির ভাগ শেয়ার রয়েছে।
শীর্ষ এই ১০ কোম্পানির তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান লিনডে বাংলাদেশ। কোম্পানিটি এ বছর চূড়ান্ত ও অন্তর্বর্তীকালীন মিলিয়ে ৫ হাজার ৬৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাতে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে একজন শেয়ারধারী পাচ্ছেন ৫৬৪ টাকা। লভ্যাংশ বাবদ কোম্পানিটি এ বছর সব মিলিয়ে শেয়ারধারীদের মধ্যে ৮৫৮ কোটি টাকা বিতরণ করছে। এরই মধ্যে লভ্যাংশের কিছু অর্থ বিতরণও করেছে কোম্পানিটি। এর মধ্যে প্রায় ৫১৫ কোটি টাকা পেয়েছেন কোম্পানিটির বিদেশি মালিকেরা। আর বাকি ৩৪৩ কোটি টাকা পেয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
১৯৭৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় লিনডে বাংলাদেশ। শুরুতে কোম্পানিটির নাম ছিল বাংলাদেশ অক্সিজেন কোম্পানি বা বিওসি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির ৪৮ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম প্রায় হাজার কোটি টাকার নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করেছে কোম্পানিটি। এ বছর নগদ লভ্যাংশ বাবদ রেকর্ড অর্থ বিতরণের পেছনে মূল কারণ কোম্পানিটির ব্যবসার অংশ বিক্রি। চলতি বছর কোম্পানিটি তাদের ঝালাই বা ওয়েল্ডিং পণ্যের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইসাব গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এই ব্যবসা বিক্রি বাবদ কোম্পানিটির যে আয় হয়, তার সিংহভাগই শেয়ারধারীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ কারণে এ বছর লিনডে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
টাকার অঙ্কে লভ্যাংশ বিতরণে পঞ্চম অবস্থানে ছিল আরেক বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট। কোম্পানিটি বছর শেষের চূড়ান্ত ও এ বছরের মাঝামাঝি অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশ বাবদ ৮০১ কোটি টাকা শেয়ারধারীদের মধ্যে বিতরণ করছে। এর বড় অংশ এরই মধ্যে বিতরণও করা হয়েছে। বিদেশী মালিকরা পাবেন প্রায় ৪৭২ কোটি টাকা, বাকি ৩২৯ কোটি পাবেন স্থানীয় উদ্যোক্তা, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানির শেয়ারের ৫৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ বিদেশী মালিকদের হাতে, বাকি ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ এ দেশীয় বিনিয়োগকারীদের হাতে।
এ তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ইলেকট্রনিক খাতের এদেশীয় জায়ান্ট কোম্পানি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ। কোম্পানিটি গত জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩০০ শতাংশ এবং উদ্যোক্তা-পরিচালকদের জন্য ২০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। উভয় ধরনের লভ্যাংশ মিলিয়ে কোম্পানিটি বিতরণ করবে প্রায় ৭২৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা পাবেন ৪৪৯ কোটি টাকা। কারণ, ওয়ালটনের শেয়ারের ৭৪ শতাংশের বেশি রয়েছে এসব উদ্যোক্তা-পরিচালকের হাতে। আর ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ২৬ শতাংশ শেয়ার। এই শেয়ারের বিপরীতে তাঁরা পাবেন ২৭৬ কোটি টাকা।
ওয়ালটন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০২০ সালে। শুরুতে কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ছেড়েছিল ১ শতাংশ শেয়ার। এ নিয়ে পরে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন উঠলে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা ধাপে ধাপে আরও কিছু শেয়ার বাজারে ছাড়েন। তাতে কোম্পানিটিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানার অংশীদারত্ব বেড়েছে। ফলে বছর শেষে কোম্পানিটির মুনাফার প্রায় এক-চতুর্থাংশ পাচ্ছেন এসব বিনিয়োগকারী।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মূলধনি কোম্পানি রবি আজিয়াটা। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন প্রায় ৫ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, যা ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রায় ৫২৪ কোটি শেয়ারে বিভাজিত। শেয়ারসংখ্যা বেশি হওয়ায় কোম্পানিটি অল্প লভ্যাংশ দিলেও তার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়। গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত আর্থিক বছরের জন্য কোম্পানিটি ১০ শতাংশ বা ১ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে গত ফেব্রুয়ারিতে। টেলিকম খাতের এই কোম্পানির বিতরণ করা ৫২৪ কোটি টাকার মধ্যে ৫২ কোটি টাকা পেয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ শেয়ারধারীরা। আর কোম্পানিটির বিদেশি মালিকেরা পেয়েছেন প্রায় ৪৭২ কোটি টাকা। লভ্যাংশ বিতরণকারী শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে সপ্তম স্থানে জায়গা করে নিয়েছে রবি আজিয়াটা।
তালিকায় অষ্টম অবস্থানে রয়েছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ। কোম্পানিটি চলতি বছর চূড়ান্ত ও অন্তর্বর্তীকালীন মিলিয়ে তিন দফায় ১ হাজার ৬৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাতে কোম্পানিটির প্রতি শেয়ারের বিপরীতে শেয়ারধারীরা পাচ্ছেন ১৬৫ টাকা। কোম্পানিটি মোট লভ্যাংশ বাবদ বিতরণ করছে ৫২০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৫২ কোটি টাকা পাবেন প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর বাকি ৪৬৮ কোটি টাকা পাবেন বিদেশি মালিকেরা।
টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ বিতরণকারী শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় নবম অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ খাতের দেশীয় কোম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ার। কোম্পানিটি গত জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরের জন্য ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ঘোষিত এই লভ্যাংশ বাবদ কোম্পানিটিকে বিতরণ করতে হবে ৩৪৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকেরা পাবেন ৩১৩ কোটি টাকা, আর প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পাবেন ৩৫ কোটি টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৯০ শতাংশেরই মালিকানা রয়েছে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে। বাকি ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
টাকার অঙ্কে লভ্যাংশ বিতরণে শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে দশম অবস্থানে রয়েছে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ। গত মার্চে সমাপ্ত আর্থিক বছরের জন্য কোম্পানিটি ৫০০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ৫০ টাকা নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাতে লভ্যাংশ বাবদ বিতরণ করা অর্থের পরিমাণ ২৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২০ কোটি টাকা পেয়েছেন বিদেশি মালিকেরা। আর ১২ কোটি টাকা পেয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ শেয়ারধারীরা। বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে বিদেশিদের হাতে। বাকি ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, ঘোষিত এই লভ্যাংশের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশ এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বিদেশি মালিকদের অংশের বিতরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।