রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল লা মেরিডিয়ানের মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান বেস্ট হোল্ডিংসকে শেয়ারবাজারে আনতে এবার আইনি ছাড় দিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর আগে ২০২০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রভাবশালী একটি পক্ষ লা মেরিডিয়ানকে ‘সরাসরি তালিকাভুক্তির’ উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন সেই প্রক্রিয়া আটকে দিয়েছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এখন সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাই আইনি ছাড় দিয়ে কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আসার পথ সহজ করে দিয়েছে।
বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত হলেও রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকার ‘লা মেরিডিয়ান’ হোটেলটি অনেকেই চেনেন। লা মেরিডিয়ান হোটেল ছাড়াও বেস্ট হোল্ডিংসের আওতায় ম্যারিয়টসহ আরও কয়েকটি হোটেল এবং বিলাসবহুল ভিলা ও রিসোর্ট উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। কোম্পানিটি গত বছর শেয়ারবাজারে আসার জন্য বিএসইসিতে আবেদন জমা দেয়।
কোনো কোম্পানিকে আইনি ছাড় দিয়ে শেয়ারবাজারে আনা উচিত নয়। যদি কোনো কোম্পানি সব আইন পরিপালন করে শেয়ারবাজারে আসার যোগ্য বিবেচিত হয়, সেটাকেই যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া উচিত।ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, বেস্ট হোল্ডিংস বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারে আসতে চায়। কারণ, কোনো কোম্পানি শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুর বেশি চাইলে ওই কোম্পানিকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আইপিওর মাধ্যমে বাজারে আসতে হয়। এই পদ্ধতি ছাড়াও স্থিরমূল্য বা ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও ছেড়ে শেয়ারবাজারে আসা যায়। সে ক্ষেত্রে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করতে হয়। বেস্ট হোল্ডিংস তাদের শেয়ারের জন্য প্রিমিয়াম বা অধিমূল্য নিতে চায় বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। বেস্ট হোল্ডিংস বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজার থেকে ৩৫০ কোটি টাকা তুলতে চায়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, আগেরবার সরাসরি তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় এবার আইপিও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেয়ারবাজারে আসার উদ্যোগ নিয়েছে বেস্ট হোল্ডিংস কর্তৃপক্ষ। শেয়ারবাজারে আসার আগেই প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ও বন্ডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যাংকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের মূলধন সংগ্রহ করেছে। প্রাইভেট প্লেসমেন্টে কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছেন বা মালিকানায় শরিক হয়েছেন শতাধিক রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটিতে ওই সব ব্যক্তি ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ আটকে আছে। তাই কোম্পানিটিকে দ্রুত বাজারে এনে ওই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ফেরত দিতে পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজটি যাতে নির্বিঘ্নে হতে পারে, সে জন্য আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে যেসব আইনি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলোয় ছাড় দেওয়া হয়েছে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পাবলিক ইস্যু আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি আইপিওতে আবেদনের দুই বছর আগে থেকে শুধু বোনাস শেয়ার ইস্যু ছাড়া অন্য কোনোভাবে মূলধন বাড়াতে পারে না। কিন্তু কোম্পানিটি এ রকম সময়ের মধ্যে বন্ড ছেড়ে বড় অঙ্কের মূলধন সংগ্রহ করেছে। বন্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে আবার শেয়ারেও রূপান্তর করা হয়েছে। তাতে আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির আইপিও আবেদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এ কারণে আইনি বিধানে কোম্পানিটিকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। আইনি ছাড়ের বিষয়টি গত ২৭ জুলাই গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
গেজেটে বলা হয়েছে, আইপিও আবেদনের আগে কোম্পানিটি যত ধরনের শেয়ার ইস্যু করেছে, সেগুলোর ওপর তিন বছরের বিক্রয় নিষেধাজ্ঞা বা লক-ইন থাকবে। যেদিন থেকে কোম্পানিটির শেয়ার পুঁজিবাজারে লেনদেন হবে, সেদিন থেকে এ লক-ইনের সময় গণনা শুরু হবে। এ ছাড়া আইপিও অনুমোদনের আগে নতুন করে আর কোনো শেয়ার ইস্যু করতে পারবে না কোম্পানিটি।
কেন আইনি ছাড় দিয়ে বেস্ট হোল্ডিংসকে শেয়ারবাজারে আসার পথ সহজ করে দেওয়া হলো জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর কোম্পানিটি কমিশনের কাছে আইপিও বিষয়ে আবেদন করে। এর আগে কমিশন কোম্পানিটির রূপান্তরযোগ্য বন্ডেরও অনুমোদন দিয়েছিল। সেই বন্ডের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি করায় এটির আইপিওর আবেদনের ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। কোম্পানির পক্ষ থেকে আমাদের কাছে আইনি ছাড়ের জন্য আবেদন করা হলে কমিশন তা অনুমোদন করে। এখন কোম্পানিটি যদি নতুন করে আবার আইপিও আবেদন করে, তবে আইনকানুন পরিপালন সাপেক্ষে কমিশন পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
জানা গেছে, বেস্ট হোল্ডিংস ২০২০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার আগে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করে। ব্যাংকগুলো প্রাইভেট প্লেসমেন্টে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার ৬৫ টাকায় কেনে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের কেনা শেয়ারের ‘মালিকানার’ অংশের কারণেই কোম্পানিটিকে সরকারি কোম্পানির তকমা দিয়ে সরাসরি তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সে সময়। তখন কাজটি করা হয়েছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কোনো অনুমোদন ছাড়া।
বিএসইসির আইন অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তি বন্ধ। তবে সরকারি কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের শেয়ারের মালিকানার অংশকে ‘সরকারি মালিকানা’ বলে দাবি করা হয়, যাতে সরাসরি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে আইনি ফাঁকফোকর ব্যবহার করা যায়।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোম্পানিকে আইনি ছাড় দিয়ে শেয়ারবাজারে আনা উচিত নয়। যদি কোনো কোম্পানি সব আইন পরিপালন করে শেয়ারবাজারে আসার যোগ্য বিবেচিত হয়, সেটিকেই যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া উচিত। কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত নয়।