শেয়ারবাজার
শেয়ারবাজার

শেয়ারবাজারে কারসাজি বন্ধ ও আস্থা ফেরানোই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যানের প্রধান কাজ

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গতকাল বিএসইসির দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ক্ষত সারিয়ে বাজারকে সুস্থ–স্বাভাবিক করাই তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

শেয়ারবাজারে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার তিনি বিএসইসিতে যোগ দিয়েছেন। ১৪–১৫ বছর ধরে অনিয়মের যে জঞ্জাল জমেছে, তা পরিষ্কার করে শেয়ারবাজারকে সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় ফেরানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে।

শেয়ার প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে অনৈতিক সুবিধা ও বাণিজ্যের মাধ্যমে নিম্নমানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি, শেয়ারের দাম বাড়াতে কারসাজিকারকদের পৃষ্ঠপোষকতা, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা তৈরিসহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর এম খায়রুল হোসেন এবং পরবর্তী সময়ে শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলে শেয়ারবাজারে অনিয়ম ও দুর্নীতির শক্তিশালী এক চক্র গড়ে ওঠে। বাজারের বাইরে শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কোম্পানির উদ্যোক্তা, কারসাজিকারক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কেউ কেউ এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ কারণে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুবিধাভোগী চক্র ভেঙে বাজারকে নিয়মনীতির মধ্যে ফেরানোই হবে নতুন কমিশনের প্রধান কাজ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসইসির পাশাপাশি দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই ও সিএসই) পর্ষদ পুনর্গঠনই হবে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যানের প্রথম কাজ। এরপর অগ্রাধিকার দিতে হবে ১৪–১৫ বছরে দুই কমিশনের সব অনিয়ম–দুর্নীতির তদন্তে। সেই সঙ্গে নতুন করে যাতে বাজারে কোনো কারসাজি ও অনিয়মের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে কঠোর আইনি ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেয়ারবাজারের সর্বাঙ্গেই এখন ব্যথা। তাই সব ক্ষত স্থানে মলম দেওয়ার কাজটি শুরু থেকেই যথাযথভাবে করতে হবে নতুন কমিশনকে। অন্যথায় ব্যথার শরীরটি আরও পচেগলে গন্ধ ছড়াতে পারে।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাজারে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা সারিয়ে লেনদেন স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনাই এখন প্রধান কাজ। প্রভাবশালী মহলকে সামাল দেওয়ার মতো নিজস্ব সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে বিএসইসিকে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

নতুন কমিশনের কাছে বিনিয়োগকারীদের আরও কিছু প্রত্যাশা ও দাবি হলো দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদ পুনর্গঠন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানো ও বন্ধ কোম্পানি তালিকাচ্যুত করা, বিএসইসির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, রোড শোর নামে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত, বিএসইসির জবাবদিহি নিশ্চিত করা, বিএসইসির আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ, মার্জিন ঋণের কাঠামোগত পরিবর্তন, মিউচুয়াল ফান্ড খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো ইত্যাদি। এরই মধ্যে ডিএসইর ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের সংগঠন ডিবিএ সংবাদ সম্মেলন করে ৩০ দফা দাবি তুলে ধরেছে।

নতুন চেয়ারম্যানের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাজারে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা সারিয়ে লেনদেন স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনাই এখন প্রধান কাজ। প্রভাবশালী মহলকে সামাল দেওয়ার মতো নিজস্ব সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে বিএসইসিকে। তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে মানুষের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা থাকে সততা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। বিএসইসিতে দীর্ঘদিন এসব বিষয় অনুপস্থিত ছিল। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির প্রতিও মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। নতুন কমিশনকে সেই আস্থা যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের সব সিদ্ধান্ত ও কাজ হতে হবে স্বচ্ছতা ও প্রভাবমুক্ত।

২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর খায়রুল হোসেনের নেতৃত্ব গঠিত কমিশনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও কেলেঙ্কারির। তাঁর টানা তিন মেয়াদে ৯ বছরে (২০১১–২০ সাল) শেয়ারবাজারে আসা কোম্পানিগুলোর একটি বড় অংশই হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো নামকাওয়াস্তে চালু রয়েছে। তিনি শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে আইপিও ছাড়ার সুযোগ করে দেন। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নিয়ে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য চলে। এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ কিছু লোক গড়ে তোলেন প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের চক্র। এসব লোক সরাসরি খায়রুল হোসেনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন।

খায়রুল হোসেনের সময়েই দেশের শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে প্রথমবারের মতো শেয়ারের দাম বেঁধে দেওয়ার এক অভিনব ব্যবস্থা ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর চালু হয়।

খায়রুলের উত্তরসূরি হিসেবে ২০২০ সালের ১৭ মে বিএসইসির চেয়ারম্যান হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই সহকর্মী শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম।

শিবলীর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত বিএসইসি কমিশন কারসাজির বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। এতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করে। তাতে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স একপর্যায়ে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর ৭ হাজার ৩৬৮ পয়েন্টের রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। তখন ডিএসইর দৈনিক লেনদেনও তিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়।

শিবলী রুবাইয়াত শেয়ারবাজারে কারসাজি বন্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি প্রায় অর্ধশত লোকসানি ও বন্ধ কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে সেগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেন। এসব উদ্যোগ ঘিরেই আবার শুরু হয় বড় ধরনের কারসাজির ঘটনা। মালিকানা বা পর্ষদ বদলের খবরে হু হু করে বাজারে দাম বাড়তে থাকে এসব শেয়ারের। একটি গোষ্ঠী আগেই কম দামে এসব দুর্বল ও লোকসানি কোম্পানির শেয়ার কিনে নেয় এবং পরে বিনিয়োগের নামে বিএসইসির সহযোগিতায় কোম্পানির পর্ষদে জায়গা করে নেয়। এরপর তারা কোম্পানিকে লাভজনক করা ও নতুন নতুন বিনিয়োগের গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নেয়। এভাবে বন্ধ কোম্পানি চালুর উদ্যোগটি মূলত শেয়ারবাজারে কারসাজির বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

এ ছাড়া সেকেন্ডারি বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়েও সক্রিয় হয়ে ওঠে কারসাজি চক্র। তাদের শিবলী রুবাইয়াত সহায়তা করেন বলে অভিযোগ আছে। তখন বাজারে বড় কারসাজিকারক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে তাঁরই সাবেক ছাত্র আবুল খায়ের হিরু ও তাঁর সহযোগীরা। এ ছাড়া শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছও হয়ে ওঠেন বড় সুবিধাভোগী। শিবলীর হাত ধরে শেয়ারবাজার ব্যবহার করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল, পরিচালক আদনান ইমামসহ আরও বেশ কয়েকজন।

যেসব কাজ করতে হবে১. বিগত দুই কমিশনের অনিয়ম–দুর্নীতির তদন্ত।২. বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।৩. শেয়ারবাজারে কারসাজি বন্ধ করা।৪. বিএসইসিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে শুদ্ধি অভিযান চালানো।৫. দুই স্টক এক্সচেঞ্জ পুনর্গঠন করে কারসাজি রোধের ক্ষমতা বাড়ানো।৬. বন্ধ কোম্পানি তালিকাচ্যুত করা ও ভালো কোম্পানিকে বাজারে আনা।৭. আইপিও ও প্লেসমেন্টের অসাধু চক্র ভাঙা।৮. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো।

শিবলী নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দেন। বিদেশে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করার নামে চালু করেন রোড শো। একের পর এক কারসাজির ঘটনায় বিনিয়োগকারীরা যখন আস্থা হারিয়ে শেয়ারবাজার বিমুখ হচ্ছিলেন, তখন বিদেশে তাঁর রোড শো আয়োজন সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নিয়োগ পান শিবলী রুবাইয়াত।

চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে শিবলীর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারসহ আর্থিক কেলেঙ্কারিরও অভিযোগ ওঠে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খায়রুল কমিশন আইপিও বাজার ধ্বংস করেছিল। আর শিবলী রুবাইয়াতের হাতে ধ্বংস হয় সেকেন্ডারি বাজারটি। তাঁর দপ্তর থেকে গুজব ছড়িয়ে দুর্বল ও বন্ধ কোম্পানিগুলোর শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ানো হতো ‘চেয়ারম্যানের আইটেম’ বলে। এভাবে কারসাজিকারকেরা বিএসইসির আশ্রয়ে–প্রশ্রয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন।

বিশ্লেষকেরা বলেন, এতসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে বিএসইসিতে শুদ্ধি অভিযান এবং নীতি সংস্কারের জোর দিতে হবে।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিএসইসির মতো ক্ষমতাবান সংস্থা বাংলাদেশে খুব কমই আছে। সংস্থাটিকে এখন বিনিয়োগকারীর আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকেও তাদের আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে। সূচকের ওঠানামায় মনোযোগী না হয়ে বাজারকে বাজারের নিয়মে চলতে দিতে হবে।