আমদানিকারক থেকে আড়তদার। তারপর পাইকারি থেকে খুচরা বিক্রেতার হাত ঘুরে পেঁয়াজ যাচ্ছে ক্রেতার কাছে। এতে হু হু করে বাড়ছে দাম।
চার স্থলবন্দরের তথ্যে দেখা যায়, রপ্তানি বন্ধের আগে এ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ভারত থেকে ৪২ হাজার ১৭৬ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়।
ভারত থেকে মূলত চারটি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি হয়। বন্দর চারটি হলো বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ ও হিলি।
চট্টগ্রামের ষোলশহরে কর্ণফুলী কমপ্লেক্স থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৮০ টাকায় কিনেছেন আবুল হাশেম। এই ক্রেতার জানা নেই, এ পেঁয়াজ কদিন আগে স্থলবন্দর দিয়ে দেশের সীমানায় আনা পর্যন্ত খরচ পড়েছে ১৭ থেকে ২৬ টাকা। তাতে গড়ে দাম পড়েছে কেজিতে ১৯ টাকা।
গড় দামের তথ্য ক্রেতাকে বলার পর অবাক হয়ে জানালেন, খুচরা বাজার পর্যন্ত আসতে এক কেজি পেঁয়াজে গড়ে ৬১ টাকার ব্যবধান! পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁর প্রশ্ন, এক কেজি পেঁয়াজে কত টাকা মুনাফা করতে হয়?
আবুল হাশেমের প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পেঁয়াজ বেচাকেনার প্রতিটি ধাপের মূল্যের তথ্য সংগ্রহে বুধবার দুপুরে কর্ণফুলী কমপ্লেক্স বাজারের খাদিজা ট্রেডার্স, আলিফ স্টোরসহ কয়েকটি দোকানে দেখা যায়, কেজিপ্রতি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, পাইকারি বাজার থেকে সোমবার ৬৫ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছেন তাঁরা। পচনশীল পণ্য হওয়ায় প্রতি বস্তায় এক–দু কেজি পেঁয়াজ নষ্ট থাকে। পরিবহন খরচ আছে। সব মিলিয়ে ৭৫ থেকে ৮০ টাকার নিচে বিক্রি করলে পোষানো যায় না।
এই পেঁয়াজ খুচরা বিক্রেতারা এনেছেন খাতুনগঞ্জ পাইকারি আড়ত থেকে। খাতুনগঞ্জের বড় আড়ত মোহাম্মদীয় বাণিজ্যালয়ের কর্ণধার মোজাম্মেল হক গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে আড়তদারদের কোনো ভূমিকা নেই। স্থলবন্দর থেকে আমদানিকারকেরা আড়তে পেঁয়াজ দেন। তাঁদের দেওয়া দরে বিক্রি করে আড়তদারেরা শুধু কমিশন পান।
চার স্থলবন্দরের তথ্যে দেখা যায়, রপ্তানি বন্ধের আগে এ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ভারত থেকে ৪২ হাজার ১৭৬ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। প্রতি কেজি পেঁয়াজের শুল্কসহ গড় আমদানিমূল্য ১৯ টাকা। এ পেঁয়াজ আমদানি করেছেন ১০৮ জন আমদানিকারক।
আমদানিকারকেরা কী বলছেন? দেশে পেঁয়াজ আমদানির সবচেয়ে বড় স্টেশন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর। এ বন্দর দিয়ে সোমবারও মেসার্স বিএইচ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং নামের একটি প্রতিষ্ঠান শুল্কসহ কেজিপ্রতি ২৬ টাকা দরে ৩০ টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে। সব মিলিয়ে এ মাসে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ২২ টাকা দরে ২৫৬ টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বাবুল হাসনাত মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বশেষ চালানে ২৬ থেকে ২৭ টাকা পড়তা (খরচ) পড়েছে, এটা ঠিক। স্থলবন্দরে আমরা তা বিক্রি করেছি ৪০ টাকায়। প্রতি কেজিতে শুধু পাঁচ টাকার মতো পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে।’ আপনারা ৪০ টাকায় বিক্রি করলে খুচরায় দাম কত হওয়া উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন,বড়জোর ৫০–৫৫ টাকা।
খুচরায় ৮০ টাকা দাম ওঠার কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে এই আমদানিকারক বলেন, দাম বাড়ার কারণ একটাই, ভারতের রপ্তানি বন্ধ হওয়া। সরবরাহ যদি বাড়ে, তাহলে দামও নেমে আসবে।
কখন কত দরে আমদানি
ভারত থেকে মূলত চারটি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি হয়। বন্দর চারটি হলো বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ ও হিলি। এসব বন্দর দিয়ে এ মাসের প্রথম দিন ভারত থেকে ৩ হাজার ৬৪ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। প্রতি কেজি পেঁয়াজে শুল্ক ১ টাকা ৩৪ পয়সা। শুল্ককরসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজের আমদানিমূল্য ছিল ১৭ টাকা। এরপর ধীরে ধীরে আমদানিমূল্য বাড়তে থাকে। পরের দুদিন প্রায় একই দরে আমদানি হয়। ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর কেজিতে আমদানিমূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ টাকায়। একটানা দুদিন ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর কেজিতে গড় আমদানিমূল্য ওঠে ২০ টাকা। এ সপ্তাহের শনিবার আমদানিমূল্য ছিল ২২ টাকা। আর রোববার তা আরও ১ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ টাকায়।
ভারত যেদিন রপ্তানি বন্ধ করেছে, সেদিন অর্থাৎ সোমবার বিকেল পর্যন্ত সোনামসজিদ ও বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ১ হাজার ২০০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। প্রতি কেজির গড় আমদানিমূল্য ছিল ২৬ টাকা। এদিন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়। এরপর গতকাল বুধবার বিকেল পর্যন্ত কোনো পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। একই দরে কেনা পেঁয়াজ গতকাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৭৫–৮০ টাকা দরে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আগামী দিনে সরবরাহ কেমন হবে, তার ওপর ভিত্তি করে পেঁয়াজের মতো পচনশীল পণ্যের বাজার ওঠানামা করে। এবারের অবস্থাও হয়েছে তাই। এখন দেশীয় মজুত দিয়ে বাজার স্বাভাবিক করার অবস্থায় নেই। বাজার স্বাভাবিক করতে হলে সরবরাহ বাড়াতে হবে। নতুন পেঁয়াজ না আসা পর্যন্ত অন্তত দুই লাখ টন পেঁয়াজ সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার।