>শেয়ারবাজারে ধস। টানা পতনের ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা।
২০১০ সালে ধসের পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ফিরেছে শেয়ারবাজার। এতে ঋণগ্রস্ত বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর পত্রকোষ বা পোর্টফোলিও জোরপূর্বক বিক্রি বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়েছে। কেবল গত এক বছরের ব্যবধানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত যেকোনো বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শেয়ারবাজারের বিভিন্ন সূচক ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনা করে থাকেন। বর্তমানে শেয়ারবাজারের যে অবস্থা, তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে খারাপ বার্তা পৌঁছাচ্ছে। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ২০১৮ সালে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা, যা গত বছর কমে হয় ৭ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। এই দুই বছরেই বিদেশিরা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন অনেক বেশি।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যে প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে চেহারা, তার সঙ্গে শেয়ারবাজারের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিএসইসি) নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজার ন্যূনতম স্থিতিশীল রাখতে পারেনি। কারণ, সরকারের নানা আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজার ভালো হবে, হচ্ছে—এমন প্রতিশ্রুতি শুনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী বাজারে বিনিয়োগ করে এখন প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
গত বছরের ১৩ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৩ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। আর গতকাল সোমবার দিন শেষে তা নেমে এসেছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭৬ কোটি টাকায়। তার মানে এক বছরে শেয়ারবাজারের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকার বাজারমূল্য হারিয়েছে।
বাজারের সবচেয়ে ভালো কোম্পানি গ্রামীণফোনে যাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের পুঁজি গত এক বছরে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমেছে ১৪৮ টাকা বা ৩৮ শতাংশ। একক কোম্পানি হিসেবে ডিএসইর বাজার মূলধনে সবচেয়ে বড় অংশীদারত্ব গ্রামীণফোনের। ফলে এ কোম্পানির শেয়ারের দরপতনে সূচকেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১ হাজার ৭৩৭ পয়েন্ট। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গতকাল সবচেয়ে বড় দরপতন ঘটে। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৮৯ পয়েন্ট বা ২ শতাংশের বেশি কমে গেছে। তাতে দিন শেষে ডিএসইএক্স সূচকটি নেমে এসেছে ৪ হাজার ১২৩ পয়েন্টে। এর ফলে এ সূচক ফিরে গেছে ৫৬ মাস আগের অবস্থানে। সূচক প্রায় পাঁচ বছরের কম হলেও অধিকাংশ শেয়ারের দাম ৯ বছর আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।
এর আগে সর্বশেষ এ সূচক ২০১৫ সালের ৭ মে ৪ হাজার ১২২ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১০ সালে ধসের পর এত দীর্ঘ সময় ধরে বাজারে এমন মন্দাভাব আর দেখা যায়নি। প্রতিদিনই শেয়ারের দাম কমছে, আর বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারাচ্ছেন। যাঁরা ঋণ করে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের অনেকে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
২০১৯ সালজুড়ে শেয়ারবাজারের টানা পতনের পর নতুন বছরে নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নতুন বছরে বাজারে প্রাণ ফেরাতে ২ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে বসে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ডিএসই কর্তৃপক্ষ। ওই বৈঠকে ডিএসইর পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হলেও সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাননি মন্ত্রী। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গুজবের কারণে পুঁজিবাজার পড়ছে। অর্থমন্ত্রীর বৈঠক–পরবর্তী সাত কার্যদিবসের মধ্যে ছয় দিনই সূচকের বড় দরপতন ঘটে।
একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অতীতে যখন বাজারে অস্থিরতা দেখা দিত, তখন বিনিয়োগকারীরা পুঁজি রক্ষায় ব্লুচিপস বা ভালো মানের কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতেন। এবার ঘটছে ঠিক উল্টো। সাম্প্রতিক দরপতনে ভালো মানের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
বাজার–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির ওপর থেকেও পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ, ২০১১ সাল থেকে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব পালন করলেও বাজারের উন্নতি তো দূরের কথা, স্বাভাবিক অবস্থাও ধরে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গতকাল প্রথম আলোকে করেন, এই মুহূর্তে বিএসইসির পুনর্গঠন ছাড়া বাজারের এ পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা খুব কম। কারণ, এখনকার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। তাঁর মতে, যে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান আইন অমান্য করে নির্ধারিত মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন করেন, সেখানে তাঁর পক্ষে বাজারে আইনের শাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বর্তমান বিএসইসির সময়কালে বাজারে সবচেয়ে বেশি বাজে কোম্পানি এসেছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়েছেন।
ইব্রাহিম খালেদের মতে, বিএসইসির শীর্ষ পদে এমন একজন ব্যক্তিকে বসাতে হবে, যাঁকে হতে হবে একাধারে দক্ষ, সৎ ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্ত। যিনি শেয়ারবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোটারি স্বার্থ ভাঙতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। তিনি বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক করার (ডিমিউচুয়ালাইজেশন) কাজটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে কয়েক শ লোকের হাতেই শেয়ারবাজারের লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে। এটা ভাঙতে হলে বিএসইসিতে সৎ, দক্ষ ও শক্ত কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে।
বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে গভীরভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কমিশনের পক্ষ থেকে যা যা করণীয়, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ডিএসইতে দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বশূন্য সিএসই
বাজার যখন চরম খারাপ অবস্থায়, তখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ নিয়ে ডিএসইর পরিচালকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে। সংস্থাটির একজন প্রভাবশালী সদস্য তাঁর পছন্দের ব্যক্তিকে ওই পদে বসাতে অতীতের সব রীতিনীতি ভঙ্গ করেন। প্রভাবশালী ওই সদস্য ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক এমডি কাজী সানাউল হককে নিয়োগ দিতে যোগ্য অনেককে বাদ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে পর্ষদ সভায় পরিচালকদের মধ্যে তুমুল বচসাও হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সানাউল হকের বিষয়ে একাধিক পরিচালক যেসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন, তাসহ এমডি নিয়োগের অনুমোদনের বিষয়টি বিএসইসিতে পাঠানো হবে। এমডি নিয়োগকে কেন্দ্র করে ডিএসইর শেয়ারধারী চার পরিচালকের মধ্যে তিনজন রয়েছেন এক পক্ষে আর অন্য পক্ষে প্রভাবশালী ওই সদস্য।
ডিএসইর পরিচালকদের এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেওয়ায় তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। যে ব্যক্তিকে নিয়ে ডিএসই দ্বিধাবিভক্ত, তিনি দায়িত্ব পেলে বাজারের উন্নয়নে কতটা কাজ করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) এমডির পদটিও সাত মাসের বেশি সময় শূন্য রয়েছে। কয়েক দফায় বিজ্ঞাপন দিয়েও সংস্থাটি এমডি নিয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চলছে দৈনন্দিন কার্যক্রম।
ভালো শেয়ারের বেশি পতন
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের মধ্যে গ্রামীণফোন ছাড়া ভালো মানের অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দাম ৭৪ শতাংশ বা ২ হাজার ৫৯৯ টাকা, স্কয়ার ফার্মার দাম ৩৬ শতাংশ বা ৯৪ টাকা, বেক্সিমকোর দাম প্রায় ৪৬ শতাংশ বা ১২ টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকের দাম ৩৪ টাকা বা ৪২ শতাংশ, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের দাম ১০৫ টাকা বা ৩৯ শতাংশ, এক্মি ল্যাবরেটরিজের দাম ৩৫ টাকা বা ৩৮ শতাংশ, বিএসআরএম লিমিটেডের দাম ৪৭ শতাংশ বা ৪০ টাকা, বেক্সিমকো ফার্মার দাম ৩০ শতাংশ বা সাড়ে ২৫ টাকা, সিটি ব্যাংকের দাম ৪৮ শতাংশ বা সাড়ে ১৫ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের দাম ৩৩ শতাংশ বা ৯ টাকা, ইউনাইটেড পাওয়ারের দাম ৭২ টাকা বা ২২ শতাংশ করে কমেছে। উল্লিখিত সব প্রতিষ্ঠানই ঢাকার বাজারের বাছাই করা ৩০ কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত ডিএস–৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাজারের যেভাবে দরপতন চলছে, তা পুরোপুরি অযৌক্তিক। ভালো কিছু কোম্পানির শেয়ারের দামের যেভাবে দরপতন ঘটছে, তার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। মির্জ্জা আজিজ মনে করেন, এই মুহূর্তে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে এগিয়ে না এলে অবস্থার উন্নতি হবে না।