দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক প্রায় ৯ মাসে কমেছে ১ হাজার ২০০ পয়েন্ট। একই সময়ের ব্যবধানে বাজার মূলধন বা শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।
এভাবেই দেশের শেয়ারবাজার সূচক তলানিতে নেমে যাচ্ছে। কারণ, বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। সূচক যেমন তলানিতে, আস্থাও তলানিতে। এখন এই অনাস্থা গিয়ে ঠেকেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর। এতে প্রতিদিনই কমছে শেয়ারের দাম, সে সঙ্গে কমছে সূচক ও লেনদেনও।
ডিএসইর প্রধান সূচকটি চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল গত ২৪ জানুয়ারি। ওই দিন সূচক ছিল ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে ও বাজার মূলধন ছিল প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। গতকাল বুধবার সেই সূচক নেমে এসেছে ৪ হাজার ৭৮২ পয়েন্টে আর বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে সূচক কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ আর বাজার মূলধন কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১৯ কোম্পানির মধ্যে ৪৬টি বা প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। এসব কোম্পানির বেশির ভাগই বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিয়ে বাজারে এসেছে। অনুমোদন দেওয়া নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহজনক লেনদেনের।
ঢাকার বাজারে গতকাল লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৩ শতাংশেরই দরপতন ঘটেছে। তাতে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৪০ পয়েন্ট বা পৌনে ১ শতাংশের বেশি। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক কমেছে ৯১ পয়েন্ট।
>বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগের গুজবে মঙ্গলবার সূচকের বড় উত্থান ঘটে
কিন্তু গতকাল বাজার আবারও ফিরে গেছে দরপতনের ধারায়
বিএসইসির মুখপাত্র সাইফুর রহমান বাজার নিয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পক্ষকেও এগিয়ে আসতে হবে।
অনাস্থা নিয়ন্ত্রকের ওপর
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরই বিনিয়োগকারীদের এখন সবচেয়ে বেশি অনাস্থা। ফলে বর্তমান কমিশনের কোনো উদ্যোগেই এখন বিনিয়োগকারীরা আস্থা খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার বাজারে যে কারসাজির ঘটনা ঘটছে, সেসব ঘটনায়ও কারও দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়নি। এ অবস্থায় বাজারে নতুন বিনিয়োগ তো আসছেই না, উল্টো মানহীন কোম্পানির মাধ্যমে বাজার থেকে নানাভাবে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবারের উদাহরণও দিচ্ছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ওই দিন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের বদল হচ্ছে। আর এই গুজবে মঙ্গলবার বাজারে সূচকের বড় উত্থান ঘটে। বিনিয়োগকারীদের অনেকে গুজবটি সত্য ধরে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেন। কিন্তু দিন শেষে গুজব গুজবই থেকে যায়। আর গতকাল বাজার আবারও দরপতনের ধারায়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিয়ে শেয়ারবাজার বিশ্লেষকেরা নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চাননি। নাম লেখা যাবে না—এই শর্তে বাজারসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলছেন, শেয়ারবাজারে সূচকের উত্থান-পতনের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিবর্তনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর থেকে আস্থা হারান, তখন সেই বাজারে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। আর বিনিয়োগ না এলে বাজারে পতন ঘটবে—এটাই স্বাভাবিক। ফলে বাজারে তারল্যসংকটেরও সমাধান হচ্ছে না।
২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। এ বিষয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যে বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই, সেই বাজারে কেউ বিনিয়োগে আস্থাশীল হবে না—এটাই স্বাভাবিক। অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, যখনই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না, তখনই বাজারে বিপর্যয় ঘটে। এ ছাড়া বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যানের তৃতীয় দফায় নিয়োগটি হয়েছে আইন ভঙ্গ করে। যখন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি আইন ভঙ্গ করে নিয়োগ পান, তখন তাঁর পক্ষে বাজারে আইনের শাসন নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব।
খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ আরও বলেন, বিএসইসিতে পরিবর্তনের পাশাপাশি ডিএসইর সদস্যসংখ্যাও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। একটি বাজার মাত্র ২৫০-৩০০ ব্রোকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তাতে কোটারি স্বার্থ কায়েম হয়। এ ছাড়া সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদকে পুরোপুরি ব্রোকারদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে।
কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ
শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠকে বাজারের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল, বাজারে ভালো কোম্পানি আনা ও ব্যাংকের বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে নগদ অর্থ জোগান দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। আইনি সীমার মধ্যে থেকে যেসব ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, তাদের রেপোর বিপরীতে নগদ অর্থ সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া এ সুবিধা নিতে এখন পর্যন্ত খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি ব্যাংকগুলো। একমাত্র বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক বিনিয়োগের জন্য রেপোর বিপরীতে ৫০ কোটি টাকা নিয়েছে।
এর বাইরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবিকে। আইসিবি ওই টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে। এরপরও বাজারে পতন চলছেই। অর্থাৎ আস্থার সংকটে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান কাজ। কিন্তু বর্তমান বিএসইসি সেই আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। তা না হলে ভালো অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম বিনিয়োগের জন্য খুবই আকর্ষণীয় পর্যায়ে নেমে আসার পরও এ বাজারে কেন বিনিয়োগ আসছে না, তার কারণ খুঁজে দেখা দরকার।