বিমানে আসছে কেজি কেজি সোনা

  • আকাশপথে কয়েকটি গন্তব্যে বিমান চলাচল চালু হয়েছে। গত ২০ দিনে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে ৫৯ কেজি সোনা এনেছেন প্রবাসীরা।

  • ঘোষণা দেওয়ায় এসব সোনার বার থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা।

  • এক মাসে বৈধভাবে এত বেশি সোনার বার এর আগে কখনোই আনা হয়নি বলে জানান কাস্টমস কর্মকর্তারা।

এক দিকে দেশে সোনার দাম বেড়েই চলেছে। আর দাম বাড়ার এ সময়ে হঠাৎ করেই আকাশপথে দেশে ঢুকছে বিপুল পরিমাণ সোনা। মধ্যপ্রাচ্যফেরত যাত্রীরা দেশে ফেরার সময় বৈধ উপায়ে ঘোষণা দিয়ে এসব সোনার বার নিয়ে আসছেন। দিন শেষে এভাবে সোনার আমদানি বাড়ছে। করোনাকালে বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ সোনার বার দেশে আসার কারণ ও হিসাব মেলাতে পারছে না খাতসংশ্লিষ্টরা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছে, বাড়তি দামের কারণে বর্তমানে দেশে সোনার চাহিদা খুব কম। বেশি দাম পাওয়ার আশায় স্বর্ণালংকার কেনার চেয়ে ক্রেতাদের অনেকের মধ্যে পুরোনো স্বর্ণালংকার বিক্রির আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাহলে বিদেশযাত্রীদের হাত ধরে আসা এত সোনা যাচ্ছে কোথায়?

কাস্টমস সূত্র জানায়, এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ বিমানবন্দরে ১০৪ কেজির বেশি সোনার বার ঘোষণা দিয়ে খালাস করেছেন যাত্রীরা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে বেশির ভাগ সোনার বার এনেছেন দুবাইফেরত যাত্রীরা।

চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে ৫১০টি সোনার বার এনেছেন যাত্রীরা। এসব সোনার বারের ওজন প্রায় ৫৯ কেজি। ঘোষণা দেওয়ায় এসব সোনার বার থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা। এক মাসে বৈধভাবে এত বেশি সোনার বার এর আগে কখনোই আনা হয়নি বলে জানান কাস্টমস কর্মকর্তারা। গত বছরের অক্টোবরে ঘোষণা দিয়ে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৯ কেজির বেশি সোনার বার এনেছিলেন যাত্রীরা। কাস্টমস সূত্র জানায়, এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ বিমানবন্দরে ১০৪ কেজির বেশি সোনার বার ঘোষণা দিয়ে খালাস করেছেন যাত্রীরা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে বেশির ভাগ সোনার বার এনেছেন দুবাইফেরত যাত্রীরা।

বৈধভাবে সোনার আমদানি বাড়ার খবর ইতিবাচক। এতে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশও বজায় থাকবে।
বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম

করোনার কারণে গত মার্চ থেকে আন্তর্জাতিক পথে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে বৈধ ও অবৈধ পথে সোনা আমদানিও কমে যায়। তাতে দেশে সোনার দাম বেড়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল। এখন আন্তর্জাতিক বেশ কিছু গন্তব্যে উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় বৈধ ও অবৈধভাবে সোনা আসা বেড়েছে বলে মনে করছেন সোনা ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বৈধভাবে সোনার আমদানি বাড়ার খবর ইতিবাচক। এতে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশও বজায় থাকবে।

লাভ-লোকসান

প্রতিটি সোনার বার শুল্ক–কর দিয়ে আনা হলেও বাজারমূল্যের চেয়ে গড়ে ১০ হাজার টাকা দাম কম পড়ে। আবার সোনার বারে খাদ মেশানোর পর মূল্য সংযোজন আরও বেশি হয়। এ কারণে যাত্রীদের মাধ্যমে এক-দুটি করে সোনার বার নিয়ে আসছেন সোনা ব্যবসায়ীরা। কারণ সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে সোনার বার আনার ক্ষেত্রে শুল্ক কর বাবদ বাড়তি খরচ হলেও ঝুঁকি অনেক কম। এ জন্য এখন যাত্রীদের মাধ্যমে বৈধভাবে সোনার বার আনার ঘটনা বাড়ছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।

সোনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুবাই থেকে এখন প্রায় প্রতি ভরি সোনার বার আমদানিতে শুল্ক-করসহ খরচ পড়ে প্রায় ৬৬ হাজার টাকা। স্থানীয় বাজারে পাকা সোনার দাম ৬৭ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতিটি বারে (১০ ভরি) প্রায় ১০ হাজার টাকা মুনাফার সুযোগ রয়েছে। এ কারণেই প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় সোনা নিয়ে আসছেন বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের। আবার অনেকে করোনায় চাকরি হারিয়ে একেবারে দেশে ফিরে আসছেন। তাই বাড়তি আয়ের আশায় ফেরার সময় জমানো টাকায় সোনার বার নিয়ে ফিরছেন।

বাড়ছে দাম, আসছে সোনা

দেশে সোনার চাহিদার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর নতুন সোনার চাহিদা ১৮-২৬ মেট্রিক টন। এ হিসাবে প্রতি মাসে সোনার চাহিদা দেড় হাজার থেকে ২ হাজার ১৬৬ কেজি। এই চাহিদার সিংহভাগ বৈধভাবে আমদানি করা সোনার মাধ্যমে পূরণ হয় না বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়।

বৈধ পথে ঘোষণা দিয়ে এত কম সময়ে এত বেশি সোনার বার আগে আর কখনো আসেনি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার আমদানিতে সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিযুক্ত চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মুনাওয়ার মুরসালীন

বৈধ পথে এমন সময়ে সোনা আমদানি বেড়েছে, যখন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে সোনার দাম চড়া। সর্বশেষ গত ১৫ অক্টোবর প্রতি ভরিতে সোনার দাম ২ হাজার ৩৩৩ টাকা বাড়িয়েছে বাজুস।

এখন দেশে সবচেয়ে ভালো মানের,

  • তথা ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণালংকারের দাম ৭৬ হাজার ৩৪১ টাকা।

  • এ ছাড়া ২১ ক্যারেট ৭৩ হাজার ১৯২ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৬৪ হাজার ৪৪৪ টাকা এবং

  • সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণালংকারের প্রতি ভরির দাম ৫৪ হাজার ১২১ টাকা।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিযুক্ত চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মুনাওয়ার মুরসালীন বলেন, বৈধ পথে ঘোষণা দিয়ে এত কম সময়ে এত বেশি সোনার বার আগে আর কখনো আসেনি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার আমদানিতে সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাত্রীরা সোনার বার বেশি আনছেন। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বৈধ পথে দুইভাবে সোনা আমদানি করা যায়। ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে সোনা আমদানি করতে পারে।

বৈধ আমদানির দুই পথ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বৈধ পথে দুইভাবে সোনা আমদানি করা যায়। ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে সোনা আমদানি করতে পারে। আবার ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ফেরার সময় ঘোষণা দিয়ে সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম ওজনের সোনার বার নিয়ে আসতে পারেন। বৈধভাবে সোনার বার আমদানির জন্য শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। ব্যাগেজ রুলের আওতায় প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) শুল্ক-কর ২ হাজার টাকা।

বৈধ পথে সোনার বার আমদানি বাড়ার কারণ সম্পর্কে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা গত সপ্তাহে বলেন, যাত্রীরা যেসব সোনার বার আনছেন, তা নিজেদের অলংকার তৈরির জন্য। আবার অনেকে বিদেশ থেকে ফেরার সময় লাভের আশায় সোনার বার নিয়ে আসছেন। আনার পর তাঁরা স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করছেন।

বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধ পথেও সোনার বার আসছে। যেসব চালান ধরা পড়ছে, সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এ মাসের প্রথম ১৫ দিনে অবৈধভাবে আসা দুটি বড় চালানসহ মোট ২৮ কেজি ৩১৪ গ্রাম ওজনের সোনার বার জব্দ করেছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। জব্দ করা চালানের বাইরে অবৈধভাবে আসা কত সোনার বার দেশে ঢুকে পড়ছে, তার হিসাব নেই কারও কাছেই।

বাজুসের চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বপন চৌধুরী বলেন, অবৈধ পথে যেসব সোনার বার আসছে, সেগুলো দেশের স্বর্ণশিল্পে যুক্ত হচ্ছে না। অবৈধ পথে আনা সোনার বার মূলত দেশের বাইরে আবার পাচার হয়ে যায়।

সোনার ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশফেরত যাত্রীরা যেসব সোনার বার নিয়ে আসছেন, তা সাধারণত ২৪ ক্যারেটের। এই সোনার বারের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ বিশুদ্ধ। বিশুদ্ধ সোনা অপেক্ষাকৃত নরম। অলংকার তৈরির সময় নানা পদার্থের খাদ মেশানো হয়। এর ওপর নির্ভর করে ২২ ক্যারেট (৯১.৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ), ২১ ক্যারেট (৮৭.৫০ শতাংশ বিশুদ্ধ) স্বর্ণালংকার হয়ে থাকে।