১৯৯৭ সালের সংজ্ঞায় টায়ার ও টিউব আলাদাভাবে আমদানির কথা বলা আছে। এখন অনেক মোটরসাইকেলে টিউব থাকে না।
ইলেকট্রনিক ফুয়েল ইনজেকশন ও অ্যান্টিলক ব্রেকিং সিস্টেম প্রযুক্তিও সংজ্ঞায় নেই।
দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনকারী কয়েকটি কোম্পানির কাছে এখন পর্যাপ্ত মজুত নেই। কিন্তু বাজারে বেশ ভালো চাহিদা আছে। এ সুযোগে ‘অবৈধ’ মোটরসাইকেল আমদানি করে বাজারে ছাড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো।
যেমন জাপানের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের ভার্সন-৩ মডেলের মোটরসাইকেলটি দেশের একমাত্র পরিবেশক এসিআই মোটরসের মজুতে নেই। তাই তারা ক্রেতাদের মোটরসাইকেলটি দিতে পারছে না। কিন্তু ঢাকায় ইয়ামাহার অনুমোদনহীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একই মডেলের মোটরসাইকেল আমদানি করে বিক্রি করছে।
সাধারণ সময়ে বৈধ পরিবেশকের তুলনায় অবৈধ আমদানিকারকেরা মোটরসাইকেল কম দামে বিক্রি করে। তবে এখন সরবরাহ-সংকট দেখা দেওয়ায় অবৈধ আমদানিকারকেরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
৫ মাসে ১২৮ কোটি টাকার মোটরসাইকেল ‘অবৈধভাবে’ আমদানি হয়েছে। বৈধ পরিবেশকের কাছে মজুত নেই। আটকে আছে আমদানি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব তুলে ধরে মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, গত মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৫টি চালানে ১২৮ কোটি টাকার মোটরসাইকেল আমদানি করা হয়েছে, যেগুলো অনুমোদিত পরিবেশকেরা আমদানি করেনি। রাজধানীর বাংলামোটর, মগবাজার, মিরপুর, পুরান ঢাকার বংশাল ও গাজীপুরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এসব মোটরসাইকেল আমদানি করে। তারা মূলত ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে এসব মোটরসাইকেল আমদানি করেছে। কোম্পানিগুলোর দাবি, এ ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা তৈরি হয়। প্রথমত, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পরিবেশকের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয়ত, মোটরসাইকেলগুলো কিনে ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ হোন্ডা লিমিটেডের (বিএইচএল) প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডে প্রতিযোগিতায় (রেস) ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মিটার কারসাজি করে এবং মেরামতের মাধ্যমে নতুনের মতো করে (রিফার্বিশড) আমদানি করা হয়। তারপর দেশে বিক্রি করা হয়। ক্রেতারা সেসব মোটরসাইকেল কেনার পর নানা সমস্যায় পড়েন। তখন ব্র্যান্ডের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
আশিকুর রহমান হোন্ডার সিবিআর ১৫০ মডেলের একটি মোটরসাইকেলের নাম উল্লেখ করে বলেন, বৈধ আমদানিকারক হিসেবে মডেলটি সিবিইউ (সংযুক্ত) অবস্থায় তাদের কেনা পড়ে ২ হাজার ৩০০ ডলারের মতো। অথচ এ মডেলের একটি মোটরসাইকেল এক হাজার ডলারের কিছু বেশি দাম দেখিয়ে আমদানি করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়।
কাস্টমসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অবৈধ আমদানিকারকেরা সাতটি মডেলের মোটরসাইকেল বেশি আমদানি করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জাপানের ইয়ামাহার এফজেডএস ভার্সন৩, এমটি১৫, আর১৫ ও এক্সএসআর, হোন্ডার সিবিআর১৫০ আর এবং সুজুকি জিএসএক্স আর১৫০ ও জিক্সার এসএফ। মূলত জাপানি উচ্চ মূল্যের মোটরসাইকেলগুলোই অবৈধভাবে বেশি আমদানি হয়।
অবৈধ আমদানির বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে এসিআই মোটরস জানুয়ারি মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেয়। এতে বলা হয়, ইয়ামাহা করপোরেশনের কারিগরি সহায়তায় এসিআই মোটরস বাংলাদেশে ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা করেছে। গাজীপুরের শ্রীপুরে এই কারখানায় ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু অনুমোদনহীন পরিবেশকের আমদানির কারণে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন এবং ব্র্যান্ডের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ নিয়ে ইয়ামাহা করপোরেশনও চিন্তিত।
এসিআইয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) একটি চিঠি দিয়ে জানায়, আমদানি নীতি অনুযায়ী নিবন্ধিত ব্র্যান্ডের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের মেধাস্বত্বধারীর সনদ পণ্য খালাসের সময় শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করতে হবে। পরে এসিআইকে চিঠি দিয়ে এনবিআর জানায়, তারা এ বিষয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদন করলে প্রতিকার পাবে।
এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, ‘আমরা আবেদন করেছি। এরপর কাস্টমস কয়েকটি চালান ধরেছে।’ তিনি বলেন, এসিআই এক বছরে যে পরিমাণ ইয়ামাহা মোটরসাইকেল বিক্রি করে, তার ২০ শতাংশের সমপরিমাণ অবৈধভাবে আমদানি হয়।
করোনাকালে সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ও খালাসে জটিলতায় বৈধ মোটরসাইকেলের ঘাটতি তৈরি হয়েছে বাজারে। তিনটি কোম্পানি জানিয়েছে, শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুরে বন্দরে জটের কারণে তাদের যন্ত্রাংশের চালান আসতে দেরি হচ্ছে। অবশ্য সবার এ সমস্যা নেই।
এসিআইয়ের সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, তাঁরা পড়েছেন খালাসজনিত জটিলতায়। ১৯৯৭ সালে সিকেডির (বিযুক্ত) যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রযুক্তি এখন অনেক বদলে গেছে। আগের সংজ্ঞায় মোটরসাইকেলের টায়ার ও টিউব আলাদাভাবে আমদানির কথা বলা আছে। এখন উন্নত প্রযুক্তির মোটরসাইকেলের টায়ারে কোনো টিউব ব্যবহৃত হয় না। এসব নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বেলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএএমএ) ২২ নভেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়, ২৩ বছরে মোটরসাইকেল প্রযুক্তিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ইলেকট্রনিক ফুয়েল ইনজেকশন, অ্যান্টিলক ব্রেকিং সিস্টেম (এবিএস), এয়ারকুলিং সিস্টেম ইত্যাদি প্রযুক্তি যোগ হয়েছে। তাই সংজ্ঞা পরিবর্তন জরুরি।
দেশে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। এখন কমপক্ষে সাতটি সুপরিচিত ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের কারখানা হয়েছে; ভারতের বাজাজ, টিভিএস ও হিরো, জাপানের হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা এবং একমাত্র দেশি ব্র্যান্ড রানার।
সার্বিক বিষয়ে বিএমএএমএর সভাপতি ও বাজারের সবচেয়ে বড় হিস্যাধারী বাজাজ ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিপণনকারী উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, কোম্পানির একক পরিবেশকের বাইরে কিছু কিছু মোটরসাইকেল আসে। তবে মোট বাজারের আকারের তুলনায় তা বেশি নয়। তিনি বলেন, সিকেডির সংজ্ঞা পরিবর্তন জরুরি। নইলে আমদানি করা পণ্য খালাস করা কঠিন হবে।