এখন পর্যন্ত ২৫টি ব্রোকারেজ হাউস সমন্বিত গ্রাহক হিসাব থেকে ১৬৩ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে বলে জানা গেছে।
দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে ১৩টি হাউসের কার্যক্রম বন্ধ
৭৩টি ব্রোকারেজ হাউসের পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকার মধ্যে।
২৫টি ব্রোকারেজ হাউস সিসিএ থেকে সরিয়েছে ১৬৩ কোটি টাকা।
ব্রোকারেজ হাউসের নতুন লাইসেন্স পেয়েছে ৫৮ টি।
শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে জমা থাকা বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও শেয়ার অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। শেয়ার কেনার জন্য গ্রাহকেরা ব্রোকারেজ হাউসে টাকা জমা দিলে আইন অনুযায়ী সেই টাকা একটি কনসলিডেটেড কাস্টমার অ্যাকাউন্ট (সিসিএ) তথা সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে জমা থাকার কথা। কিন্তু একশ্রেণির ব্রোকারেজ হাউস সিসিএ থেকে টাকা সরিয়ে ফেলে, যেটাকে মানি লন্ডারিং বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) দেওয়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসির) বিভিন্ন চিঠি, পরিদর্শন প্রতিবেদন, বিএসইসির ওপর করা বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ সরিয়ে নেওয়ার এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সূত্রে জানা যায়, ব্রোকারেজ হাউসগুলো যে বিনিয়োগকারীদের টাকা সরিয়ে ফেলে, তা খতিয়ে দেখতে এক বছর আগে তারা দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইকে নির্দেশ দিয়েছে। সে অনুযায়ী ডিএসইর তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ২৪টি ব্রোকারেজ হাউস গ্রাহকের হিসাব থেকে ৫৮ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে এবং তা ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মালিকেরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। এদিকে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ নামের একটি ব্রোকারেজ হাউস ১০৫ কোটি টাকা সরিয়েছে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৮৭ এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ২০২০ অনুযায়ী লেনদেনের কমিশন ও বার্ষিক মাশুল ছাড়া সিসিএ শুধু গ্রাহকদের টাকা জমা ও তোলার কাজে ব্যবহার হওয়ার কথা।
ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, শুরুর দিকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার ঘটনা ছিল একেকটা। তখন নজর দেওয়া হয়নি। বিএসইসি এবং ডিএসই-সিএসইর যথাযথ তদারকির অভাবেই এসব ঘটনা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
ডিএসই কর্তৃপক্ষ বলছে, গ্রাহক হিসাবের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকে ব্রোকারেজ হাউসের হাতে। আইন বহির্ভূতভাবে এসব টাকা মালিকপক্ষ নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও এ ধরনের ঘটনা ডিএসইর পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব নয়। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাহকের অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ডিএসইরই দায়িত্ব। এ জন্য নিয়মিতভাবে হাউস পরিদর্শন করার কথা থা্কলেও এ ব্যাপারে তাদের মনোযোগ কম।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে কি না, তা দেখার কাজ স্টক এক্সচেঞ্জের। স্টক এক্সচেঞ্জ কোনো অনিয়ম আমাদের নজরে আনলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
ডিএসইতে বর্তমানে ২৫০টি ব্রোকারেজ হাউস রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি ব্রোকারেজ হাউসের কার্যক্রম বিভিন্ন কারণে বন্ধ রয়েছে। নতুন করে লাইসেন্স পেয়েছে ৫৮টি।
গ্রাহকের টাকা সরাল যারা
জানা গেছে, ডিএসই ২০২০ সালের ৯ জুলাই ১২টি, ১৬ জুলাই ২টি, ২৫ আগস্ট ২টি এবং ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৮টি ব্রোকারেজ হাউস পরিদর্শন করে। এগুলোতে গ্রাহকদের ১০৭ কোটি টাকা জমা থাকার কথা থাকলেও পাওয়া যায় ৪৯ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়ায় ৫৮ কোটি টাকা।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী অ্যাপেক্স ইনভেস্টমেন্ট ২৬ কোটি ২৮ লাখ, সিনহা সিকিউরিটিজ ৭ কোটি ৮১ লাখ, আল মুনতাহা ট্রেডিং কোম্পানি ৪ কোটি ৬৯ লাখ, এক্সপো ট্রেডার্স ৪ কোটি ৩৪ লাখ, জয়তুন সিকিউরিটিজ ২ কোটি ৭০ লাখ, মিরর ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ২ কোটি ৫৪ লাখ, এরিনা সিকিউরিটিজ ২ কোটি ১০ লাখ, এম সিকিউরিটিজ ২ কোটি ৯ লাখ, সাদ সিকিউরিটিজ ১ কোটি ৭৫ লাখ এবং শ্যামল ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা সরিয়েছে।
একই ঘটনা অন্য যেসব হাউসে সংঘটিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে কাজী ফিরোজ রশীদ সিকিউরিটিজ, পিস সিকিউরিটিজ, নূরে আলম সিদ্দিকী অ্যান্ড কোম্পানি, হাবিবুর রহমান সিকিউরিটিজ, এসিই ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস, আসিফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি, ডায়নামিক সিকিউরিটিজ, হাসান সিকিউরিটিজ, এ কে খান সিকিউরিটিজ, পাশা ক্যাপিটাল, আদিল সিকিউরিটিজ, ব্লু-চিপস সিকিউরিটিজ, অ্যালায়েন্স সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এবং এরশাদ সিকিউরিটিজ।
পরিদর্শন প্রতিবেদনের পর ডিএসই প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউসের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চায় এবং টাকা সমন্বয় করতে বলে। এরপর সাদ সিকিউরিটিজ ছাড়া সবাই ব্যাখ্যা দেয় এবং টাকাও সমন্বয় করে।
সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। ভুল করে ঘাটতি হয়েছিল, সমন্বয়
করা হয়েছে।
গ্রাহকের টাকা সরানোর ঘটনা জানার পর বিএসইসি ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সিসিএর তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে তদারকির নির্দেশ দেয় ডিএসইকে। এই হিসাব যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরেও ১৬টি হাউসকে সতর্ক করেছিল বিএসইসি।
নিরীক্ষায় উঠে আসে আরও অনিয়ম
বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বিএসইসির ওপর একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে। এই প্রতিবেদনে গ্রাহকের সমন্বিত হিসাব থেকে ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের টাকা সরিয়ে নেওয়ার আরও ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এ জন্য নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিএসইসি ও ডিএসইর তদারকি ব্যবস্থার ঘাটতিকে দায়ী করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহকের সিসিএ থেকে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ নামের একটি ব্রোকারেজ হাউস ১০৫ কোটি টাকা সরিয়েছে। ডিএসইর হিসাবে যে ২৪টি ব্রোকারেজ হাউসে এ ধরনের ঘাটতি রয়েছে, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ তার বাইরে।
এ বিষয়ে অডিট অধিদপ্তরের প্রশ্নের জবাবে ডিএসই বলেছে, ‘ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের কেউ স্বেচ্ছায় না জানালে ডিএসইর কারও পক্ষেই তা জানা সম্ভব নয়।’ এদিকে ডিএসইর ওপর করা ২০১৭-১৮ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের কমপ্লায়েন্স অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনিয়ম তদারকির জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা বিএসইসি। সংস্থাটি তা পালন না করায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।
পরিশোধিত মূলধনের তথ্য নেই
ব্রোকারেজ হাউসগুলোর পরিশোধিত মূলধন কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। যে ব্রোকারেজ হাউসের পরিশোধিত মূলধন যত বেশি, তার আর্থিক ভিত্তিও তত শক্তিশালী। কিন্তু ডিএসই ব্রোকারেজ হাউসগুলোর পরিশোধিত মূলধনের তথ্য সংরক্ষণ করে না।
ডিএসইর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এম সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, ব্রোকারেজ হাউস অনুযায়ী আলাদা তথ্য নেই।
তবে ডিএসই থেকে পাওয়া একটি তালিকা অনুযায়ী, ১ কোটি টাকার কম পরিশোধিত মূলধনসম্পন্ন হাউস তিনটি। ১ থেকে ৫ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ৭৩টি, ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ৭০টি, ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার ১৫টি, ১৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার ৩৭টি, ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকার ১০টি, ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকার ৫টি, ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার ৫টি, ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার ৮টি এবং ২৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ১২টি ব্রোকারেজ হাউস রয়েছে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সিসিএ থেকে টাকা সরানো অনাকাঙ্ক্ষিত। দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে নিয়ে বিষয়টি অনুসন্ধান করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে বিএসইসিকে।
যাঁদের টাকা আত্মসাৎ হয়েছে, তা ফেরতের কী হবে—এ বিষয়ে মির্জ্জা আজিজ বলেন, আদালতের মাধ্যমে অপরাধীদের সম্পত্তি বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা উচিত।