ক্রেতার আস্থা ফিরছে, পণ্য বিক্রি বাড়ছে

এপ্রিল ও মে মাসের স্থবিরতা কাটিয়ে জুন থেকে বিক্রি বাড়তে শুরু করে। এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায়বিক্রি ৭০-৮০ শতাংশ।

করোনাভাইরাস দেশের ব্যবসায় যে মন্দাভাব এনেছিল, তা কেটে যাওয়ার পথে। দোকানে ক্রেতা বাড়ছে, বিক্রি বাড়ছে। ফলে দুশ্চিন্তা কাটছে বড় করপোরেট থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ীদের।

কেনাকাটা করতে মানুষ কতটা বাইরে যায়, তা দেখা গেল রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে। গত শুক্রবার এ এলাকায় মানুষের ভিড় ছিল ব্যাপক। পা ফেলার জায়গা ছিল না ফুটপাতে। রাস্তায় ছিল চিরাচরিত যানজট।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয় মাস পর তাঁরা এমন দৃশ্য দেখছেন। যেমন, থ্রি স্টার জোন নামের একটি পোশাকের দোকানের মালিক মো. আলম মিয়া বলেন, দুই মাস ধরে বেচাকেনা মোটামুটি ভালো। তাঁর দোকানে মাসে চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে যেটা গড়ে ৬ লাখ টাকা হতো। তিনি বলেন, এখন আর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিন্তা নেই। বরং খরচ মিটিয়ে লাভও হচ্ছে। শীতের আঁচ পড়লে বিক্রি আরও বাড়বে।

তিন কারণ ■ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ছাঁটাইয়ের প্রবণতা কমেছে। ■ বাজারে টাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। ■ গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী, যা চাহিদা ঠিক রাখছে।

শুধু নিউমার্কেট এলাকা নয়, গত দুই সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতার ভিড় আগের চেয়ে বেড়েছে। বেচাবিক্রি বাড়তি। দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরুর পর ব্যবসা খাদে পড়েছিল। ওই অবস্থা চলেছে মে মাসের শেষ পর্যন্ত। জুনে যখন দোকানপাট খোলা হয়, তখন গৃহস্থালি ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম, মুঠোফোন, মোটরসাইকেল, নির্মাণসামগ্রীসহ কয়েকটি খাতে বেচাকেনা বেশ বেড়ে যায়।

করপোরেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) ধারণা ছিল, জুনে বাড়তি বিক্রি ছিল আগের দুই মাস দোকানপাট বন্ধ থাকার কারণে। ফলে বাড়তির ধারাটি থাকবে না। কিন্তু দেখা গেল, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পণ্য বিক্রি ইতিবাচকই রয়েছে।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত দুই সপ্তাহে ভোগ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্য, পোশাক ও জুতা, ইলেকট্রনিকস, নির্মাণসামগ্রী খাত, আবাসন, আসবাব, গৃহস্থালি সামগ্রী, পরিবহন, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন খাতে বেচাবিক্রির খোঁজ নেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা মোটা দাগে বলছেন যে বিক্রির পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কোনো খাতে আগের চেয়ে বিক্রি বেশি। আবার কোনো খাতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিক্রি হচ্ছে। যেমন রেস্তোরাঁ।

সিইওদের চোখে ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ তিনটি—১. অর্থনীতি আরও সংকটে পড়ার আশঙ্কা কেটেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই ও বেতন কর্তন বন্ধন হয়েছে। অনিশ্চয়তা কাটায় ক্রেতার আস্থা ফিরছে। ২. রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়ানো, বেসরকারি ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি ও কেনাবেচা শুরু হওয়ায় বাজারে টাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। ৩. গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী, যা সামগ্রিক চাহিদা গতিশীল রাখছে।

২৫টি শ্রেণির আওতায় প্রায় ৬ হাজার ৩০০ পণ্যের উৎপাদনকারী ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, এপ্রিল-মে মাসে বিক্রি কিছুটা নেতিবাচক ছিল। এখন বিক্রি বাড়তি।

কোন খাতে কী পরিস্থিতি

দেশের ভোগ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের (এফএমসিজি) বাজারে বিক্রি বাড়ার হার ইতিবাচক। এ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার গত সেপ্টেম্বরেই প্রথম আলোকে জানিয়েছিল তাদের বিক্রি বাড়ছে। সম্প্রতি আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান স্কয়ার টয়লেট্রিজের বিপণন প্রধান জেসমিন জামানও একই তথ্য জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোশন ও শ্যাম্পুর মতো কিছু পণ্যের চাহিদা কিছুটা কম। তবে লোশনের চাহিদা শীতে বাড়বে।’

করোনার কারণে এবার পয়লা বৈশাখ ও দুই ঈদে প্রত্যাশা অনুযায়ী পোশাক ও জুতা বিক্রি হয়নি। এরপর ব্র্যান্ডগুলো মূল্যছাড় দিয়ে ব্যবসায় গতি আনার চেষ্টা করে। বাটা শু কোম্পানির রিটেইল অপারেশন ম্যানেজার আরফানুল হক জানান, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বিক্রি ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

আসবাব বিক্রির চিত্র কী, তা জানান স্বনামধন্য ব্র্যান্ড হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান ও ঢাকার কাজীপাড়ার এওয়াইজেড ফার্নিচারের অংশীদার আবদুল খালেক। তাদের হিসাবে, প্রতি মাসেই বিক্রি কিছু কিছু বাড়ছে।

করোনার শুরুর দিকে ওয়াশিং মেশিনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস পণ্যে বিক্রি বেড়ে যায়। জুন থেকে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা বেড়েছে। পরিস্থিতি কেমন গেছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যায় রেফ্রিজারেটরের বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের বিক্রির চিত্র দেখে। করোনার সংক্রমণের শুরুর মাস অর্থাৎ গত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি করেছে। যদিও গত বছরের একই সময়ে তাদের বিক্রি ছিল ১৫ লাখ।

করোনার ধাক্কা ধীরে ধীরে কাটছে বলে উল্লেখ করেন র‌্যাংগস ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের (সনি-র‌্যাংগস) ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জানে আলম। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী দুই-তিন পর বিক্রির পরিমাণ পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে যাবে।

করোনার ধাক্কা সামলে আবাসন খাত চাঙা হতে শুরু করেছে। ক্রেতারা ফ্ল্যাটের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাতে অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে করোনার আগে যে বিক্রি ছিল তার কাছাকাছি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। বিক্রি শুরু হওয়ায় নতুন প্রকল্পও নিতে শুরু করেছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সহসভাপতি সোহেল রানা বলেন, করোনা পরিস্থিতির আরেকটু উন্নতি হলে ব্যবসা আরও বাড়বে।

আবাসন খাতে গতি আসায় রড, সিমেন্ট, ইট, পাথর, বালু, টাইলসের মতো নির্মাণসামগ্রীর বিক্রিও বেড়েছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণেও খাতটি দ্রুত চাঙা হচ্ছে। আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন ইস্পাতের ব্যবসা আগামী মার্চ থেকে স্বাভাবিক হওয়ার আশা প্রকাশ করেন।

সারা দেশে বাস চলাচল শুরু হয় জুন থেকে। দেশের আন্তজেলা বাসসেবায় যাত্রীসংখ্যা মোটামুটি ভালো। তবে পর্যটনকেন্দ্রকেন্দ্রিক বাস ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাসে যাত্রী এখনো তুলনামূলক কম। আর যেসব বাস ভারত যেত, সেগুলো বন্ধ রয়েছে। ঢাকার বাসেও যাত্রীসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশাচালকদের আয়ও বেড়েছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের মতো নয়।

উড়োজাহাজেও যাত্রী বাড়ছে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস করোনার আগে দেশের ভেতরে সাতটি গন্তব্যে প্রতিদিন ৫৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করত। বর্তমানে ৪৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তাতে উড়োজাহাজের ধারণক্ষমতার ৭৫-৮০ শতাংশ যাত্রী ভ্রমণ করছেন। আর দেশের বাইরে সপ্তাহে ৯০টি ফ্লাইটের মধ্যে বর্তমানে যাওয়া-আসা করছে ২২টি। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম জানান, প্রতি মাসেই যাত্রীসংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

‘গ্রামে ভালো অবস্থা’

কৃষিতে এ বছর ধান, সবজি, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন পণ্যের ভালো দাম পেয়েছেন কৃষকেরা। যার সুফল হলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভালো অবস্থা।

গ্রামে পণ্য বিক্রির পরিস্থিতি কী, তা জানা যায় একটি বহুজাতিক বাজার জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, এপ্রিল-মে মাসে শহরে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বিক্রি কমেছিল ২৫ শতাংশ। গ্রামে কমে মাত্র ৪ শতাংশ। জুনেই গ্রামে বিক্রি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসে।

গ্রামীণ অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকলে কৃষিযন্ত্রের বিক্রি বাড়ে। এ বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, ‘এখন মৌসুম নয়। তবে আমরা যে সাড়া পাচ্ছি, তাতে আগামী মৌসুম খুব ভালো যাবে।’