করোনার কারণে শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধের প্রায় দুই মাস হতে চলেছে। কিন্তু এ বন্ধের আগে ঋণ করে যাঁরা বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, সেসব বিনিয়োগকারীর ঋণের সুদ বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। অর্থাৎ বাজার বন্ধ থাকলেও ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের সুদের চাকা ঘুরছে।
ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া সুদে টাকা এনে তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি সুদ মওকুফ না করে, তবে শেয়ারবাজারের ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এককভাবে সুদ মওকুফ করা সম্ভব নয়। কারণ, কয়েক বছর ধরে বাজারে মন্দাভাব থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোও আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। এদিকে করোনার ক্ষতি কাটাতে সরকার লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও শেয়ারবাজারের প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীরা তার সুফল পাচ্ছেন না। তাই ওই প্রণোদনার আওতায় সুদ মওকুফের দাবি করেছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা করোনার কারণে বন্ধের সময়গুলোতে মার্জিন বা প্রান্তিক ঋণের সুদ মওকুফের দাবি তুলেছেন। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার আওতায় এ সুবিধা দেওয়ার দাবি করেছেন তাঁরা। বর্তমানে শেয়ারবাজারে ১: ০.৫ হারে মার্জিন ঋণসুবিধা বলবৎ রয়েছে। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগকারী ঋণযোগ্য শেয়ারে নিজে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে তার বিপরীতে ৫০ টাকা ঋণসুবিধা পান। বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউস শেয়ারের বিপরীতে এ ঋণসুবিধা দিয়ে থাকে। বিনিয়োগকারীরা বাড়তি মুনাফার আশায় এ ঋণসুবিধা নিয়ে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ ঋণের কারণেই নিজের পুঁজিও হারাতে হয় বিনিয়োগকারীদের। ২০০৯-১০ সালে শেয়ারবাজার ফুলে ফেঁপে ওঠার জন্য মাত্রাতিরিক্ত মার্জিন ঋণকেও দায়ী করা হয়। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে বাজার ছেড়েছেন। বিপুল পরিমাণ অনাদায়ি ঋণ নিয়ে এখনো হিমশিম খাচ্ছে শেয়ারবাজারের অনেক প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির পর এখনো কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ি রয়ে গেছে। অনেক ঋণগ্রহীতাকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও বছর বছর ওই সব ঋণের বিপরীতে সুদের হিসাব কষে যাচ্ছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে জানা গেছে, করোনার কারণে শেয়ারবাজার বন্ধের সময়ে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফের একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কমিশনে উপস্থাপন করা হয়। তবে বিগত কমিশন এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এরই মধ্যে বিএসইসিতে নতুন নেতৃত্ব এসেছে।
>গত ২৬ মার্চ থেকে লেনদেন বন্ধ থাকলেও ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ঋণের সুদ বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। মওকুফের দাবি বিনিয়োগকারীদের।
জানতে চাইলে মার্চেন্ট ব্যাংকারদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ঋণের সুদের হারের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। এ মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় নেই। তাই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেই বন্ধকালীন সময়ের জন্য ঋণের সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শেয়ারবাজারে ঋণদাতা একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেয়ারের বিপরীতে বিতরণ করা ঋণের বর্তমান সুদহার প্রতিষ্ঠানভেদে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। তবে চক্রবৃদ্ধি হিসাবের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সুদ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। এ উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে বর্তমান শেয়ারবাজারে মুনাফা করা অত্যন্ত দুরূহ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তবু লোভে পড়ে বুঝে না বুঝে শেয়ারবাজারে অনেক বিনিয়োগকারী ঋণ করে বিনিয়োগ করেন। শেষে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটা ভিন্ন।
করোনার কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ। স্বাধীনতার পর এত দীর্ঘ সময় শেয়ারবাজারে আর কখনোই লেনদেন বন্ধ ছিল না। সরকারের সাধারণ ছুটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ করা হলেও কারোরই ধারণায় ছিল না, বন্ধ এতটা দীর্ঘায়িত হবে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা যেমন শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ঋণ সমন্বয় করতে পারেননি, তেমনি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, মানবিক বিবেচনায় এ দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে অন্ততপক্ষে বন্ধের সময়টুকুর জন্য বিনিয়োগকারীদের সুদ মওকুফ বা স্থগিত করা উচিত। এ জন্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদ মওকুফেরও উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ উদ্যোগে সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত না নিলে সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জানা গেছে, সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করা হলেও শেয়ারবাজারে সুদের হিসাব কষা হয় দিনের হিসাবে। যখন কোনো বিনিয়োগকারী শেয়ারের বিপরীতে ঋণ নেন তখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে ওই বিনিয়োগকারীর শেয়ার তথা পোর্টফোলিও বা পত্রকোষ জিম্মায় থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার নিচে নেমে গেলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জোরপূর্বক শেয়ার বিক্রি (ফোর্সড সেল) করে দিয়ে ঋণ সমন্বয় করে। কিন্তু বাজার পরিস্থিতির কারণে সেটিও অনেক সময় সম্ভব হয় না। এতে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়ই পুঁজি হারান।