শস্যচুক্তি নবায়ন হয়নি

গম আমদানিতে নতুন বিপদে বাংলাদেশ 

বাংলাদেশে গম আমদানির প্রধান উৎস ইউক্রেন। দেশটির সঙ্গে খাদ্যশস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে রাশিয়া বেরিয়ে যাওয়ায় সংকটের আশঙ্কা।

ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে বিনা বাধায় শস্য রপ্তানির বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গতকাল সোমবার। রাশিয়ার আপত্তিতে নতুন করে আর চুক্তিটি নবায়ন হয়নি। তাতে ইউক্রেন থেকে গম আমদানিতে তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ নতুন করে বিপদে পড়তে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশে কম দামের সাধারণ আমিষযুক্ত গমের অন্যতম উৎস ইউক্রেন। ইউক্রেনের বিকল্প উৎস ভারত গত বছরের মার্চ থেকে গম রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। আবার সব ব্যাংক রাশিয়া থেকে গম আমদানির ঋণপত্র খুলতে আগ্রহী নয়। এর বাইরে সাধারণ আমিষযুক্ত গমের উৎস রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ব্রাজিল। তবে এই তিন দেশ থেকে গম আমদানি খুব বেশি হয় না। অর্থাৎ রাশিয়া চুক্তি নবায়ন না করায় বাংলাদেশের জন্য সাধারণ আমিষযুক্ত গমের উৎস ছোট হয়ে এসেছে।

ইউক্রেন থেকে গম আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি নবায়ন না হলে ইউক্রেন থেকে আমদানির সুযোগ হবে না। এখন রাশিয়া থেকে গম আমদানিতে সব ব্যাংক যাতে ঋণপত্র খোলে, সে জন্য তাগাদা দেওয়া উচিত সরকারের। ব্রাজিলের ফলন শেষ। রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া থেকেও কিছু পরিমাণ গম আমদানির সুযোগ আছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগে বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৬৬ লাখ টন গম আমদানি হতো। দেশে উৎপাদিত হয় ১০–১১ লাখ টন। দেশের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ভাতের পরই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় গম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার। এ কারণে গমের সরবরাহে ব্যাঘাত হলে বা দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ে।

যেভাবে এল চুক্তি নবায়ন না করার ঘোষণা 

জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় গত বছরের ২২ জুলাই রাশিয়া–ইউক্রেনের মধ্যকার প্রথম শস্যচুক্তির মেয়াদ ছিল ১২০ দিন। একই বছরের ১৮ নভেম্বর চুক্তিটির মেয়াদ ১২০ দিন বাড়ানো হয়। চলতি বছরের ১৭ মার্চ সব পক্ষ সম্মত হলেও রাশিয়া ১২০ দিন মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়নি। পরদিন ১৮ মার্চ রাশিয়া চুক্তির মেয়াদ ৬০ দিন বাড়াতে সম্মত হয়, যা শেষ হয়েছে গতকাল। 

চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ক্রিমিয়ায় কার্চ সেতুতে হামলা চালায় ইউক্রেন। ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ভূখণ্ডকে সংযোগ করেছে এই সেতু। এরপরই চুক্তি নবায়ন না করার ঘোষণা দেয় রাশিয়া। গতকাল বিবিসির খবরে বলা হয়, শস্যচুক্তি নবায়ন না হওয়ার বিষয়টি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্ক, ইউক্রেন ও জাতিসংঘকে জানিয়ে দিয়েছেন। 

নবায়ন না করার প্রভাব

চুক্তি নবায়ন না করার খবরে বৈশ্বিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বা পণ্য লেনদেনের বাজারে গমের দামে উত্থান–পতন শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য লেনদেনের বাজার শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) গতকাল সোমবার কেনাবেচার শুরুতে গমের দাম ৩ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। অবশ্য পরে আবার দাম কমে আসে। 

চুক্তি নবায়ন না হওয়ার খবরে গতকাল বাংলাদেশের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারেও গমের দামে অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে দিন শেষে বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। যেমন রোববার প্রতি মণ গম বেচাকেনা হয় ১ হাজার ৪০০ টাকায়। চুক্তি নবায়ন না হওয়ার খবরে গতকাল মণপ্রতি দাম ২০ টাকা বেড়েছে। 

কেন বিপদে বাংলাদেশ

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশ দুটি থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। তখনই গম আমদানি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন দেশের আমদানিকারকেরা। সে সময় ভারতের বাজার খোলা থাকায় বাংলাদেশ বেশি সমস্যায় পড়েনি। কিন্তু গত বছরের মার্চেই ভারত গম রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এরপরও নভেম্বর মাস পর্যন্ত ভারত থেকে গম আমদানি হয়েছিল। ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে গত বছরের জুলাই মাসে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে শস্যচুক্তি হয়। চুক্তির পর নিরাপদে ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হয়। ফলে গমের সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা দূর হয়। এখন ভারতের পাশাপাশি আরেক অন্যতম উৎস ইউক্রেন থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। 

ইউক্রন থেকে নতুন করে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূলত সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। কারণ, শস্যচুক্তির পর বাংলাদেশের মতো ৩০টি দেশ ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করত। আমদানিতে স্পেন ও তুরস্কের পরই ছিল বাংলাদেশের অবস্থান। তবে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাশিয়া আবার চুক্তিতে ফিরতে পারে, এমন আশাবাদ নিয়ে আছেন বাংলাদেশের একজন আমদানিকারক।