সহজে কোম্পানি খুলে ব্যবসা করার জন্য সরকার কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক ব্যক্তির কোম্পানি (ওপিসি) খোলার অনুমতি দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে এ সুযোগ তৈরি করা হয়। আইনি সুযোগ দেওয়া হলেও এক ব্যক্তির কোম্পানি করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সাড়া মিলছে না।
কোম্পানি নিবন্ধনের সরকারি প্রতিষ্ঠঅন যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন এক ব্যক্তির নিবন্ধিত কোম্পানি ২১০টি। এর মধ্যে আইন সহজ করার পর ২০২১-২২ অর্থবছরে নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ১২৪টি। ওই অর্থবছরে সব মিলিয়ে নিবন্ধিত কোম্পানি ছিল ১০ হাজার ৮২২টি। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তির কোম্পানি খোলার প্রতি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ খুব বেশি বাড়েনি। এ জন্য প্রচার-প্রচারণার ঘাটতিকে দায়ী করছেন উদ্যোক্তারা।
আরজেএসসি সূত্রে জানা যায়, আগে একক মালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসায়িক অনুমতিপত্র (লাইসেন্স) নিয়েই ব্যবসা করতে হতো। ২০২০ সালে আইন পরিবর্তনের সময় এক ব্যক্তির কোম্পানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ করপোরেট কর ছাড় দেওয়া হয়।
আরজেএসসি সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সব মিলিয়ে এক ব্যক্তির কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ১০টি। তবে নিবন্ধনের জন্য প্রতিদিন ১ থেকে ৩টি আবেদন জমা পড়ে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী সময়ে এ নিবন্ধন দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে আরজেএসসির নিবন্ধক শেখ শোয়েবুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। একাধিক দিন তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করতে চাইলেও তিনি দেখা করেননি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
তবে আরজেএসসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক ব্যক্তির কোম্পানি যাঁরা খুলছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এরই মধ্যে একক মালিকানার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। দেশে এক ব্যক্তির মালিকানায় অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করলেও সবাই নিবন্ধিত নয়। কারণ, অনেকে নিবন্ধন নিয়ে কোম্পানি পরিচালনাকে বাড়তি ঝামেলা মনে করেন। এ ছাড়া নিবন্ধন নিয়ে নিয়মনীতির আওতায় আসতেও অনীহা রয়েছে অনেকের। আরজেএসসিতে নিবন্ধিত কোম্পানিকে নিয়মিত নিরীক্ষার আওতায় আসতে হয়। সেটি অনেকে ঝামেলা মনে করেন।
এ বিষয়ে সনদধারী হিসাববিদ বা নিরীক্ষকদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ব্যক্তি কোম্পানি খুললে স্বচ্ছতার জন্য তাঁকে নিয়মিতভাবে নিরীক্ষা করতে হবে। এটা আইনে বলা আছে। নিরীক্ষা করতে গেলে কিছু খরচ করা লাগে সত্য, তবে প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোনো সমস্যা আছে কি না, সেটি নিরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে।
এক ব্যক্তির কোম্পানি হলো এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে একজন ব্যক্তিই ওই কোম্পানির মালিকানায় থাকেন। তবে একজন নমিনিও থাকেন। তাতে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবসার ক্ষেত্রে কোম্পানি ও সম্পদের সুরক্ষার সুবিধার জন্য ওপিসি হিসেবে নিবন্ধন নিতে পারেন। যৌথ মালিকানা বা একাধিক মালিকানার কোম্পানির ক্ষেত্রে দায় থাকে বেশি, আর এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে দায় সীমিত। কোম্পানির নিবন্ধন থাকলে ব্যবসা পরিচালনা অনেক সহজ হয়।
এন্টারপ্রাইজ ৩৬০ লিমিটেড নামের একটি ব্যবসা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমান উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেকেই কোম্পানি খোলার পরামর্শ নিতে আসেন। তবে ওপিসি খোলার ব্যাপারে আগ্রহ খুবই কম। উদ্যোক্তাদের মধ্যে এখনো একধরনের ধারণা রয়েছে যে কোম্পানি করতে হলে যৌথ মালিকানা থাকলে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। তাই অনেকে নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবসা করে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ওপিসি কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট করহার বর্তমানে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। আর দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে এই করহার ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই হিসেবে ওপিসি কোম্পানিগুলো ৫ শতাংশ কর ছাড় পেয়ে থাকে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বেকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঝে একবার আমাদের প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানি করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। কারণ, কোম্পানি করলে ব্যাংকঋণ পাওয়ার মতো বিষয়ে কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও নিরীক্ষা করানো, কর প্রদানের মতো বিষয় চিন্তা করে পরে আর এগোইনি।’
কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ওপিসি কোম্পানিগুলোর প্রাইভেট লিমিটেড এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে কোম্পানির বার্ষিক লেনদেন বা টার্নওভার ১ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার মধ্যে হতে হবে। আর এক ব্যক্তির কোম্পানির ক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধন হতে হয় সর্বনিম্ন ২৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা।
আরজেএসসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে ৪ হাজার ৯৭৬টি। আগের অর্থবছরে মোট কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছিল ১০ হাজার ৮২২টি। ২০২০–২১ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ১২৫টি। সেই হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে গত দুই অর্থবছরের তুলনায় অর্ধেকের কম কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তারই প্রভাব কোম্পানি নিবন্ধনে পড়েছে।
আরজেএসসি বলছে, কাগজপত্র ঠিক থাকলে কোনো উদ্যোক্তা কোম্পানি খোলার আবেদন করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নিবন্ধন পেয়ে যান। তবে কাগজপত্রে কোনো ঘাটতি থাকলে আবেদনপত্র সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠানো হয়।