সরকার কি আদৌ অর্থ পাচারকারীর নাম জানতে চায়

নাতালি চুয়ার্ড
নাতালি চুয়ার্ড

২০১৪ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে সরকার জোরালোভাবে দেশের মানুষকে আশ্বাস দিয়েছিল যে আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবে। আর পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংক থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর থেকে প্রতিবছরই সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

ভিন্ন বক্তব্য দেওয়া শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে। ওই বছরের ১১ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ৩০০ ধারায় বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের সংবাদ আসলে অতিশয়োক্তি।’ এরপর বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১ সালের ৭ জুন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন, আমাদের দিন।’ আর সর্বশেষ গত ১০ জুন বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’

তথ্য পেতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে আমরা সরকারকে জানিয়েছি, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তথ্যের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করা হয়নি। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এ ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব এবং সেটি তৈরি করতে হবে। এটি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছি
নাতালি চুয়ার্ড, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সরকার আসলে পর্যায়ক্রমে সুইস ব্যাংকসহ টাকা পাচারকারীদের বিষয়ে ক্রমশ পিছু হটেছে। কেন সরকারের এই উল্টো পথে যাত্রা এ নিয়ে নানা কথা বলা হয়। তবে সুনির্দিষ্ট একটি উত্তর পাওয়া গেল গতকাল বুধবার। বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড গতকাল বলেছেন, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধপথে আয় করা হয়েছে—এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য চায়নি।’ জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ আয়োজিত ডিকাব টকে তিনি এসব কথা বলেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ওই দিন প্রজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে, বিদেশ থেকে পাচারকৃত টাকা এখন থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ৭ শতাংশ কর দিয়ে আনা যাবে।

প্রসঙ্গত, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বা এসএনবির ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ।

নাতালি চুয়ার্ড বিষয়টি নিয়ে বলেন, ‘তথ্য পেতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে আমরা সরকারকে জানিয়েছি, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তথ্যের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করা হয়নি। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এ ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব এবং সেটি তৈরি করতে হবে। এটি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশিরা কত টাকা জমা রেখেছে ওই তথ্য প্রতিবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক দিয়ে থাকে এবং ওই অর্থ অবৈধপথে আয় করা হয়েছে কি না, এটি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’

সুতরাং নাতালি চুয়ার্ডের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা তো দূরের কথা, সুইস ব্যাংক থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাই বাংলাদেশ কখনো করেনি। যদিও আমরা জানি বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে ঠিকই আমানতকারীদের তথ্য পাচ্ছে। আসলে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) নামে সুইস ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো আছে, যা চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। এর আওতায় কেউ যদি নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন, তাহলে সেই তথ্য দিতে বাধ্য থাকে সুইস ব্যাংকগুলো। এই ১২১ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।

সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি আদৌ অর্থ পাচারকারীর নাম বা তথ্য জানতে চায়? টাকা পাচার নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের একমাত্র পদক্ষেপ ছিল ৮ আগস্টের প্রজ্ঞাপন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ওই দিন প্রজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে, বিদেশ থেকে পাচারকৃত টাকা এখন থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ৭ শতাংশ কর দিয়ে আনা যাবে। অর্থাৎ পাচার করলে শাস্তি না, পাচারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নয়, বরং সুবিধা দেওয়ার নীতির বাইরে আসলে সরকার কিছুই করছে না। বাকি যা যা করে, তা সবই বক্তৃতা, আর কিছু নয়।