নানামুখী সংকটে এখন দেশের অর্থনীতি। এ সংকট যেমন সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস তুলেছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যকে কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে। শিল্পকারখানাগুলো এখন খাবি খাচ্ছে সংকট মোকাবিলায়। একদিকে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে কমছে বিক্রি। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন উদ্যোক্তাদের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে সংকট সামাল দিচ্ছে, কী ধরনের কৌশল নিচ্ছে এবং সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা কি—ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন শীর্ষপর্যায়ের পাঁচটি খাতের পাঁচজন উদ্যোক্তা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন সুজয় মহাজন, মাসুদ মিলাদ ও শুভংকর কর্মকার।
দেশের চলমান সংকটে সিমেন্টসহ বিভিন্ন খাতের অনেক কোম্পানি বড় অঙ্কের মূলধন হারিয়েছে। আর এটি হয়েছে মূলত ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে। সিমেন্ট, ইস্পাত খাতের কোম্পানিগুলোর কাঁচামাল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। কোম্পানিগুলো কাঁচামাল আমদানির জন্য যে ঋণপত্র খোলে, তা মূলত বিলম্বে পরিশোধের সুবিধাসম্পন্ন ঋণপত্র। অর্থাৎ পণ্য আমদানির এক বছর পর দায় পরিশোধের সুযোগ পায়। গত বছরের ডিসেম্বরে আমরা যেসব কাঁচামাল আমদানি করেছিলাম, সেগুলো দেশে এসেছে গত জানুয়ারিতে। ওই সময় প্রতি ডলারের দাম ৮৫ টাকা ধরে আমরা সিমেন্টের দাম নির্ধারণ করি এবং বাজারে তা বিক্রি করে দিই। এখন বছর শেষে এসে যখন ওই আমদানি দায় শোধ করছি তখন প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ১০৬ টাকা। শুধু ডলারের এ বাড়তি দামের জন্যই আমাদের ২৫ শতাংশ খরচ বেড়ে গেছে। যেহেতু পণ্য বিক্রি করে দিয়েছি আগে তাই বিক্রীত পণ্যের বিপরীতে এখন এসে মূলধন থেকে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এতে এ খাতের সব কোম্পানি লোকসানে চলে গেছে। এ লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি আমাদের মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রথমত, বিক্রীত পণ্যের বিপরীতে বড় ধরনের লোকসানে ফেলেছে। আবার এখন নতুন করে আমদানি করতে গিয়ে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অথচ ব্যাংক থেকে আমরা এখন না পাচ্ছি প্রয়োজনীয় ঋণপত্র খোলার সুবিধা, না পাচ্ছি বাড়তি ঋণ। আগে ব্যাংক যদি আমাদের ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিত, এখন দিচ্ছে ৭৫ কোটি টাকা। অথচ আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন আমাদের দরকার আগের চেয়ে বেশি ঋণ। বর্তমানে বাড়তি ঋণসুবিধা তো পাচ্ছিই না, কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতেও বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এমনিতে চলমান পরিস্থিতিতে লোকসানে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছি। তার মধ্যে ঋণপত্র খুলতে না পারার বিষয়টি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে।
নতুন করে আমদানির যে ঋণপত্র খোলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই ইউপাস ঋণপত্র। অর্থাৎ এক বছর পরে দায় পরিশোধ করতে হবে। এক বছর পর যখন দায় পরিশোধের সময় আসবে তখন যদি ডলারের দাম আরও বেড়ে যায় তাহলে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হবে। তাতে অনেক কোম্পানি মূলধন–সংকটে পড়বে। তা সত্ত্বেও বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখছি। একে তো ডলার–সংকট, তার সঙ্গে রয়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের স্বল্পতা। এতে উৎপাদন অনেক কমে গেছে, আর বেড়েছে উৎপাদন খরচ। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে সিমেন্ট, রডসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে গেছে।
এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের কিছুটা সুরক্ষা বা স্বস্তি দিতে সরকার নতুন করে প্রণোদনা ঘোষণা করতে পারে। করোনার সময় স্বল্প সুদে দেওয়া সরকারি প্রণোদনা ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। সেটি করা না হলে এত দিনে অনেক ব্যবসায়ীকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হতো। ডলার–সংকট কাটাতে বাজারে ডলারের জোগান বাড়াতে গিয়ে প্রায় লাখ কোটি টাকার বেশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে চলে গেছে। সেখান থেকে ব্যবসায়ীদের জন্য যদি কিছু প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বল্পমেয়াদি ঋণকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তাতে শিল্পোদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।