বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন যে স্বস্তিদায়ক অবস্থা ছিল, তা আর নেই। দেশের বর্তমান অবস্থাকে ভবনের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘এবার মনে হচ্ছে, ভবনের বাইরের কাঠামোটা ঝকমকে রয়ে গেলেও ভেতরটা নড়বড়ে।’
আজ রোববার সকালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কতটা ঝুঁকিপূর্ণ’ শীর্ষক সংলাপ ও মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, ব্যাংকিং খাত নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, বহিঃস্থ খাত নিয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
এ ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সংলাপে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও অপচয়—এসব সমস্যা আগে থেকেই চলছিল। সেগুলোর সমাধান হয়নি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চলমান বৈশ্বিক সমস্যা। এখনকার এই খারাপ পরিস্থিতিও হয়তো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব; কিন্তু বাজার, ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কর্মদক্ষতা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। আর ব্যষ্টিক পর্যায়ে স্থানীয় সরকার বলে কিছু দেখা যায় না। সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ নেই, অর্থাৎ বাড়ির ওপরের দিকটা সব ঠিক দেখালেও ভেতরটা নড়বড়ে হয়ে আছে।’
শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রীলঙ্কায় সামষ্টিক সমস্যার পাশাপাশি ব্যষ্টিক অর্থনীতিরও সংকট ছিল। দেশটির স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব খাতে কর্মদক্ষতা উচ্চ মানের, কিন্তু গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে ও সময়মতো উদ্যোগ না নেওয়ায় দেশটি মহাসংকটে পড়েছে। বাংলাদেশেও কিন্তু এসব লক্ষণ আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎপরতায় ঘাটতি আছে উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন বলেন, ‘সংকট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছি, দেখব—এ–জাতীয় কথাবার্তা বলছে। কিন্তু কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জনগণকে জানানো উচিত। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় মানুষের অংশগ্রহণ নেই, যদিও তাদের তথ্য জানার অধিকার আছে।’
ব্যাংকিং খাতে গভর্ন্যান্স ও সুশাসনের অভাব সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায়ই দেখি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকদের বিশেষ সুসম্পর্ক (কমফোর্ট জোন) আছে। এ কারণে দেখা যায়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি), অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বা বিভিন্ন চেম্বার বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করে।’
সংকট কাটাতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সালেহউদ্দিন বলেন, এখনই তাৎক্ষণিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া না হলে ব্যাংকিং খাত দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মধ্যে পড়বে। এ জন্য আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই; বরং ব্যাংকিং খাতের যেসব নিয়ম আছে, সেগুলো প্রতিপালনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
পাশাপাশি সরকারি অর্থের অপচয় রোধ, পাচার বন্ধ আর দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতি গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।