পুরোনো গাড়ি কোথায় কিনতে পাওয়া যায়, দাম কেমন পড়ে

দেশে বছরে প্রায় এক লাখ ব্যবহৃত গাড়ি বিক্রি ও বিনিময় হয়। সাধারণত ৮ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা দামের গাড়ির চাহিদাই বেশি। দেশে সব মিলিয়ে বছরে কমবেশি ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবহৃত গাড়ি বেচাকেনা হয়।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে ব্যবহৃত গাড়ির চাহিদা বাড়ছে

দেশে এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন বাড়ছে, তেমনি যোগাযোগ অবকাঠামোরও উন্নয়ন ঘটছে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাঁদের বেশি দাম দিয়ে নতুন বা রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনার সুযোগ নেই, তাঁরা সামর্থ্যের মধ্যে পুরোনো গাড়ি কিনেই নিজেদের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত তথা পুরোনো গাড়ির বাজারও বড় হচ্ছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই প্রতি মাসে সাড়ে চার হাজারের মতো ব্যবহৃত গাড়ি বিক্রি হয়। ক্রেতাদের মধ্যে সেডান গাড়ির (সাধারণ ব্যক্তিগত গাড়ি) পাশাপাশি স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যালের (এসইউভি) চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, সম্ভাবনাময় হলেও এই বাজারে বেশ কিছু সংকটও রয়েছে। যেমন ব্যবহৃত গাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ সহজলভ্য নয়। এ ছাড়া গাড়ির মালিকানা পরিবর্তনে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি উচ্চ করহার, মূল্যবৃদ্ধি, নতুনভাবে আরোপিত কার্বন কর রয়েছে। এর ওপর সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থারও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাজারে। তা না হলে বিক্রি আরও বাড়ত।

ব্যবহৃত গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা মহানগর পুরোনো গাড়ি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির (ঢভকল) সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বাড়তি করহার ও বিআরটিএর হয়রানির কারণে ব্যবহৃত গাড়ির বাজার কাঙ্ক্ষিত গতিতে বাড়ছে না।

কোথায় বেশি পাওয়া যায়

দেশে ব্যবহৃত গাড়ি বেচাকেনা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। ব্যবহৃত গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢভকলের তথ্য অনুসারে, ঢাকায় এখন ব্যবহৃত গাড়ির তিন শতাধিক বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে বনানী এলাকায় ২০টির মতো বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে এসইউভি ও দামি সেডান গাড়ির চাহিদা বেশি। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ ও ধানমন্ডি এলাকায় ৩০টির বেশি বিক্রয়কেন্দ্র আছে।

এসব এলাকায় একটু সাশ্রয়ী দামের গাড়ি বেশি বিক্রি হয়। তেজগাঁও, কাকরাইল ও মণিপুরিপাড়া এলাকায় অর্ধশতাধিক বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি, বারিধারা জে ব্লক, কারওয়ান বাজার, সংসদ ভবনসংলগ্ন মণিপুরিপাড়া, শ্যামলী ও উত্তরার দিয়াবাড়ি প্রভৃতি এলাকায় ব্যবহৃত গাড়ির অনেক বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশে নারায়ণগঞ্জসহ কিছু এলাকায় আছে ব্যবহৃত গাড়ির দেড় শতাধিক বিক্রয়কেন্দ্র।

ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যবহৃত গাড়ি সারা বছরই কমবেশি বিক্রি হয়। তবে কোনো উপলক্ষে বিক্রি কিছু বাড়ে। যেমন নতুন বছরের শুরুতে সন্তানের স্কুলে যাতায়াতের প্রয়োজনে অনেক অভিভাবক গাড়ি কেনেন। তাতে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাস এই গাড়ি বিক্রি বৃদ্ধি পায়।

ব্যবহৃত গাড়ির বাজার কেমন

আলাপকালে ঢভকল নেতারা জানান, প্রতিটি বিক্রয়কেন্দ্রে মাসে গড়ে ১৫টি ব্যবহৃত গাড়ি বিক্রি হয়। এ ছাড়া অনেকে গাড়ি বিনিময় করেন। সে হিসেবে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার ৪৫০টি বিক্রয়কেন্দ্রে বছরে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ গাড়ি বিক্রি ও বিনিময় হয়। গাড়ির মডেল, বয়স ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে দাম সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত ৮ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা দামের গাড়ির চাহিদাই বেশি। ঢভকল নেতাদের ধারণা, দেশে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত গাড়ির বাজার কমবেশি ১৫ হাজার কোটি টাকা হবে।

ব্যবসায়ীরা জানান, বিক্রি হওয়া ব্যবহৃত গাড়ির মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার। মাইক্রো ৩০ শতাংশ ও এসইউভি ধরনের গাড়ি ২০ শতাংশের মতো। চাকরিজীবী, ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা ব্যবহৃত গাড়ি বেশি কেনেন।

কীভাবে এসব গাড়ি বাজারে আসে জানতে চাইলে ঢভকলের সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ হোসেন জানান, ঢাকার প্রতিটি এলাকায় পুরোনো গাড়ি বেচাকেনার খোঁজখবর রাখেন এমন কিছু মধ্যস্থতাকারী রয়েছেন। তাঁরা গাড়ি বিক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। অনেক ক্রেতা-বিক্রেতা সরাসরি বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগ করেন। এ ছাড়া ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও ব্যবহৃত গাড়ি বেচাকেনা হয়।

ব্যবহৃত গাড়ির বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ফেসবুক লাইভ করেন মো. মাকসুদুল হাসান। তিনি বলেন, অনলাইন মাধ্যমে ঘরে বসেই গ্রাহকেরা গাড়ির দরদাম ও অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পান। এতে তাঁদের সময় ও খরচ বাঁচে। অনলাইনে দেখে একটি ধারণা পাওয়ার পর তাঁরা সরাসরি বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে গাড়ি কেনেন।

পুরোনো গাড়িতে কেন আগ্রহ

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বিশেষ করে যাঁদের নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকে না বা যাঁরা অর্থ সাশ্রয় করতে চান, তাঁরাই ব্যবহৃত গাড়ির ক্রেতা। কারওয়ান বাজারের জেবি অটোসের ব্যবসায়িক অংশীদার আল জাবির চৌধুরী বলেন, নতুন বা রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ক্রয়মূল্যের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা কমে বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে ব্যবহৃত গাড়ির ক্ষেত্রে দু-তিন লাখের বেশি দাম কমে না। অর্থাৎ রিসেল ভ্যালু ভালো হওয়াতেও অনেকে এ গাড়ি কেনেন। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময় ব্যবহারের পর কিছু অর্থ খরচ করে বিক্রয়কেন্দ্র থেকে অন্য মডেলের গাড়ি বিনিময় করা যায়।

চাহিদা বেশি টয়োটার

বিক্রেতারা জানান, ব্যবহৃত গাড়ির বাজারে জাপানের টয়োটা, হোন্ডা, মিতসুবিশি ও নিশান—এই চার ব্র্যান্ডেরই রাজত্ব চলছে। এর মধ্যে টয়োটা সবচেয়ে এগিয়ে। টয়োটার এক্স-করলা, অ্যালিয়ন, প্রিমিও, প্রোবক্স, রাশ, অ্যাভেঞ্জা, প্রিয়াস, সিনথিয়া ইত্যাদি মডেলের গাড়ি বেশ জনপ্রিয়।

ইউসড কার বনানী লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, টয়োটা গাড়ির সরবরাহ বেশি, যন্ত্রাংশও সহজলভ্য। ফলে এগুলোর রিসেল ভ্যালু ভালো। অন্যান্য ব্যক্তিগত গাড়ি বাজেট-ফ্রেন্ডলি (ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে) হলেও যন্ত্রাংশের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে সেগুলোর রিসেল ভ্যালু ভালো নয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে বর্তমানে ২২টির বেশি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে টয়োটা, হোন্ডা, হুন্দাই, হাভাল, কিয়া, মাজডা, এমজি, ডিএফএসকে গ্লোরি, প্রোটন, চেরি ইত্যাদি ব্র্যান্ডের ব্যবহৃত গাড়ি তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়।

এ ছাড়া এসইউভি ধরনের দামি গাড়ির মধ্যে মিতসুবিশি পাজেরো; নিশানের এক্স ট্রেইল ও জুকি; টয়োটার প্রাডো, হ্যারিয়ার; হুন্দাইয়ের টাকসন; ল্যান্ড রোভার; অডি; মার্সিডিজ বেঞ্জ ও বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের ব্যবহৃত গাড়ির প্রতিও ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে।

এক বছরে দাম ১৫% বেড়েছে

ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক বছরে ব্যবহৃত গাড়ির দাম ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এ ছাড়া যেসব নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ি পুরোনো গাড়ির বাজারে আসছে, সেগুলোর দাম ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা বেড়েছে।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার মদিনা কার কালেকশনসের ব্যবস্থাপক নুর হাসান বলেন, ‘আগে যেসব পুরোনো গাড়ি ৭ লাখ টাকায় কিনতাম, বর্তমানে সেগুলোর দাম বেড়ে সাড়ে ৮ লাখ হয়েছে। ফলে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

পরিবেশ করের প্রভাব বেচাকেনায়

সরকার চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যক্তি পর্যায়ের একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে পরিবেশ সারচার্জ আরোপ করেছে। এতে পুরোনো গাড়ি বেচাকেনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন। এ ছাড়া আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম বাড়ার কারণেও ব্যবহৃত গাড়ির বাজারে জোগান কমছে বলে জানান তাঁরা।

ঢভকলের সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ হোসেন বলেন, সরকার যেভাবে গাড়ির ওপরে নানাভাবে কর বাড়াচ্ছে, তাতে এটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

রাজধানীতে ব্যবহৃত গাড়ির একটি বিক্রয়কেন্দ্র

আরও যেসব সমস্যা

ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যবহৃত গাড়ি ক্রয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাংকঋণ পাওয়া যায় না। ফলে তাঁদের এবং ক্রেতাদেরও নগদ টাকা দিয়েই গাড়ি কিনতে হয়। ব্যবহৃত গাড়ির মালিকানা পরিবর্তনে দীর্ঘসূত্রতাও আরেকটি বড় সমস্যা। কারণ, মালিকানা পরিবর্তনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দীর্ঘ সময় নেয়। এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের মম ভেহিক্যালের মালিক মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘গাড়ি বিক্রির দু-তিন দিনের মধ্যে মালিকানা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় কাগজ ও গাড়ির মালিককে নিয়ে বিআরটিএতে গেলেও সব কাজ শেষ হতে ছয় মাস লেগে যায়। ফলে গ্রাহকদের কাছে আমাদের প্রতিশ্রুতি ঠিক থাকে না।’