৪৭ পণ্যের মধ্যে ২৬টিরই দাম বাড়ল, মূল্যস্ফীতিও বাড়তি

ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এটিকে‘অস্বস্তিকর বা অতিরিক্ত নয়’ বলছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। 

টানা পাঁচ মাস কমার পর মূল্যস্ফীতি আবার বাড়ল। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত ছিল।

মূল্যস্ফীতি বাড়লেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তিত নয় সরকার। পৌনে ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে ‘অস্বস্তিকর বা অতিরিক্ত নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। গতকাল রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। সভা শেষে মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য সাংবাদিকদের জানানো হয়। 

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে অস্বস্তি নেই। মজুরি বাড়ছে। এই মূল্যস্ফীতি অস্বস্তিকর নয়, অতিরিক্তও নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো অতি মূল্যস্ফীতি (হাইপার ইনফ্লুশন) হয়নি। ভারতে আমাদের চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি। জিম্বাবুয়েতে ৩০০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়। বাংলাদেশে তেমন পরিস্থিতি নয়। বাংলাদেশের এই মূল্যস্ফীতি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত।’

বর্তমানে আমরা একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতির বৃত্তের মধ্যে রয়েছি। দেশে যে মূল্যস্ফীতি এখন চলছে, তা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

রোজার সময় মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে কি না, প্রশ্ন করা হলে শামসুল আলম বলেন, রোজার সময় চাহিদা বাড়ে। আমরা ছোলা, বুট, পেঁয়াজ, চিনি—এসব পণ্য বেশি কিনি। চাহিদা বেশি থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু এবার যথেষ্ট পরিমাণ ঋণপত্র খোলা হয়েছে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।

৪৭ পণ্যের মধ্যে ২৬টির দাম বেড়েছে

সোয়া চার শ পণ্য ও সেবা দিয়ে মূল্যস্ফীতি গণনা করে বিবিএস। সংস্থাটির মূল্যস্ফীতির গণনায় মোটাদাগে ৪৭টি পণ্যের দামের হিসাব থাকে। বিবিএসের হিসাবে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে ওই ৪৭টি পণ্যের মধ্যে ২৬টিরই দাম বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় আছে, চাল, তেল, চিনি, মরিচ, হলুদ, আদা, মাংস, ডিম, লবণ, দুধ ইত্যাদি। অর্থাৎ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যেরই দাম বেড়েছে। এর ফলে সীমিত আয়ের মানুষের সংসার চালাতে আগের চেয়ে খরচ বেড়েছে। এদিকে গত কয়েক মাসে বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমবেশি বাড়তির দিকেই ছিল। এমনকি নিম্ন আয়ের মানুষের প্রোটিনের অন্যতম উৎস ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ডিমের দামও বেশ বেড়েছে। ফলে অনেক দিন ধরে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে নেই।

বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে, মানুষের মজুরি সেভাবে বাড়েনি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। তার মানে মজুরি বাড়লেও বাড়তি টাকা দিয়েও আগের মতো পণ্য কেনা সম্ভব হচ্ছে না মানুষের পক্ষে। 

গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বেশ বাড়ানো হয়। তাতে ওই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। মূল্যস্ফীতির ওই হার ছিল গত ১১ বছর ৯ মাসের (১৪৪ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর মূল্যস্ফীতি আর কখনো ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।

গত আগস্টের পর টানা পাঁচ মাস মূল্যস্ফীতি কমেছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে এসে তা আবার বেড়ে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর গ্রাম ও শহরে এখন মূল্যস্ফীতি প্রায় সমান। গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ, শহরে এই হার ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। 

কেন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে

গত জানুয়ারি মাসে দুবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে আরেকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, যা কার্যকর হয়েছে চলতি মাস থেকে। এর বাইরে সরকারের নির্বাহী আদেশে শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দামও। ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ২৬৬ টাকা বাড়ানো হয়েছিল, যদিও মার্চে তা ৭৬ টাকা কমানো হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজি সিলিন্ডার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে আড়াই শ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন বলে ভোক্তারা। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এসব কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বর্তমানে আমরা একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতির বৃত্তের মধ্যে রয়েছি। দেশে যে মূল্যস্ফীতি এখন চলছে, তা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। তাই মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বাড়ল, না কমল—এই মাত্রাগত পরিবর্তনে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় কমার ইঙ্গিত দেয় না।’ 

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমদানি, পণ্য পরিস্থিতিসহ দেশের অর্থনীতির সার্বিক যে অবস্থা, তাতে এখান থেকে খুব সহজে বের হওয়ার কথা নয়। মূল্যস্ফীতি যাতে আর না বাড়ে, সে জন্য নিয়মিত বাজার তদারকি করা জরুরি।