প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মাসের শেষ দিকে চার নিত্যপণ্যের (চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর) শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ দেওয়ার পর ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে এক সপ্তাহ। শুল্কছাড়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কাজ শুরু করলেও বিষয়টি চূড়ান্ত করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পবিত্র রমজান উপলক্ষে ছাড় দেওয়ার এই পরিকল্পনা করা হয়। তবে এখন এই শুল্কছাড় দেওয়া হলেও রোজার সময়ে বাজারে এর প্রভাব কতটুকু হবে, তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা।
রোজা শুরু হতে বাকি এক মাসের মতো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে বেশির ভাগ নিত্যপণ্য এখন উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। রোজার সময় পণ্যের মূল্য কমাতে শুল্কছাড়ের উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে এখন পর্যন্ত কাগজে–কলমে এ বিষয়ে অগ্রগতি নেই। এর মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি করে বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন। এনবিআর যদি এখনই শুল্কছাড়ের সিদ্ধান্ত জানায়, তাহলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে রোজার মাঝামাঝি কিংবা শেষে। কারণ, চিনি ও তেলের মতো পণ্য আমদানির পরে তা পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ে কোম্পানিগুলো।
ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি টিকে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আতহার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেলে ১৫ হাজার টাকার মতো শুল্ক দিতে হয়। এই শুল্ক কমানো হলে তার প্রভাব বাজারে নিশ্চয়ই পড়বে। তবে এখন শুল্কছাড়ে পণ্য আমদানির সুযোগ দিলে, তা রোজার আগে বাজারে আসবে এমন সম্ভাবনা কম। রোজার মাঝামাঝি বা শেষের দিকে তা বাজারে আসতে পারে। তবে শুল্কছাড়ের ঘোষণার পর বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম রোজার আগে নতুন করে আর বাড়ার সম্ভাবনা কম।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর কর্মকর্তারা এসব পণ্যের আমদানি শুল্কের বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করা শুরু করেছেন। তবে ঠিক কবে নাগাদ এ বিষয়ে ঘোষণা আসবে, তা নিয়ে নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এমনকি শুল্কে কতটুকু ছাড় দেওয়া হতে পারে, সে বিষয়টিও চূড়ান্ত হয়নি। তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যেহেতু সরকার চাইছে, সুতরাং এনবিআর এ ব্যাপারে ইতিবাচক। অল্প সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে।
যেসব ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে বিদ্যমান শুল্ক কাঠামোতে পণ্য আমদানি করেছেন, তাঁরা বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ, এখনই এসব পণ্য বিক্রি করতে না পারলে শুল্কছাড়ের পর তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। আর যেহেতু রোজা শুরু হতে বেশি বাকি নেই, তাই নতুন করে পণ্য এনে রোজার বাজার ধরা নিয়েও শঙ্কায় আছেন আমদানিকারকদের কেউ কেউ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুরান ঢাকার এক আমদানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেজুরের মতো পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ রয়েছে। আবার কিছু পণ্যে শুল্কের হার একেক সময় একেক রকম হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকেরা বিড়ম্বনায় রয়েছেন। রোজার কিছু পণ্য এরই মধ্যে নিয়ে এলেও আরও পণ্য আমদানির বিষয়ে দোটানায় পড়েছি। কারণ, বেশি শুল্কের পণ্যের দাম আর শুল্কছাড়ের পণ্যের দাম এক হবে না। তখন লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হতে পারে।’
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, রোজায় যেসব পণ্য বেশি ব্যবহার হয়, তার মধ্যে শুল্ক রয়েছে চিনি, তেল, খেজুর ও পেঁয়াজ আমদানিতে। বড় জাহাজে তেল ও চিনি আমদানি হয়। গতকাল মঙ্গলবার বন্দরের জাহাজ অবস্থানের তালিকা অনুযায়ী, অপরিশোধিত পাম তেল ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেলবাহী ৯টি জাহাজ বন্দর জলসীমায় রয়েছে। এসব জাহাজে রয়েছে ৬৯ হাজার টন অপরিশোধিত পাম তেল এবং ৬১ হাজার ৭৩৩ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল। এই তেল খালাসের প্রক্রিয়া চলছে। গতকাল বন্দরে চিনির কোনো জাহাজ ছিল না।
আমদানি করা এসব পণ্যে দ্রুত শুল্কছাড় দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরে এখনো সিদ্ধান্ত না আসা বেশ অবাক করার মতো বিষয়। কারণ, সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত না এলে যে উদ্দেশ্যে এই ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তার সুফল পাওয়া যাবে না। যেহেতু সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা এসেছে, এটা হয়তো করা হবে। কিন্তু আমরা চাই, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হোক, যাতে বাজারে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসে।’
রোজার সময় সাধারণত ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও খেজুরের চাহিদা বেশি থাকে। এসব পণ্যের বেশির ভাগের চাহিদা মেটে আমদানি করে। ব্যবসায়ীদের মতে, রোজায় ভোজ্যতেলের চাহিদা অন্তত সাড়ে তিন লাখ টন। সম্প্রতি সয়াবিন তেলের আমদানি কমলেও পাম তেলের আমদানি বেড়েছে। তবে সয়াবিন ও পাম—দুই ধরনের তেলের জন্যই ঋণপত্র খোলা বেড়েছে। রোজায় চিনির চাহিদাও বেশ বাড়ে। চিনি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে বলে জানা গেছে।