‘গাড়িচালক, বুয়া বা বাড়ির চাকরের নামেও ঋণ নেওয়া হয়েছে’

ঋণ খেলাপি
প্রতীকী ছবি

দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা অভিযোগ করেছেন যে খেলাপি ঋণ নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও বেনামে ব্যাংক থেকে কত ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। বেনামে নেওয়া এসব ঋণ অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়েছে। বেনামি ঋণের বোঝা আবার ব্যবসায়ীদের ওপর চাপানো হচ্ছে।

‘গাড়িচালক, বুয়া বা বাড়ির চাকরের নামেও ঋণ নেওয়ায় ঘটনা আছে’, এমন মন্তব্য করেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, দিন শেষে রাষ্ট্রের এসব বোঝা চাপানো হয় শিল্পমালিকদের ওপরে।

আজ রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার সিএ ভবন অডিটরিয়ামে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘মনিটরি পলিসি অ্যান্ড ইমপ্লিকেশন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন বিটিএমএ সভাপতি।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ব্যাংক খাত থেকে কেউ বাড়ির বুয়ার নামে ঋণ নিচ্ছেন, কেউবা নিয়েছেন গাড়িচালক বা চাকরের নামে। এসব ঋণ পরে আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের এসব বোঝা শিল্পমালিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশে ঋণখেলাপি নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু বেনামে নেওয়া এসব ঋণ নিয়ে কথা হয় না। এসব তথ্য সামনে আসা উচিত।

তিনি আরও বলেন, দেশের জ্বালানি খাতের জন্য কোটি কোটি ডলার ব্যয় করা হচ্ছে আমদানির পেছনে। প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলার খরচ হচ্ছে। আমদানি–নির্ভর জ্বালানি খাত দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

মুদ্রানীতিতে শিল্পের জন্য কিছু নেই এমন অভিযোগ করে মোহাম্মদ আলী প্রশ্ন করেন, সরকার নিজে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোথা থেকে। তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা আরও পরিষ্কার হতে হবে। এখন শিল্প বন্ড চালু করা প্রয়োজন।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘অর্থনীতি এখন এমন এক জায়গায় এসেছে, যেখানে যারা বিদ্যুতের ব্যবসা করে তারা রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে। এ ধরনের লুণ্ঠনকারীদের হাতে সবকিছু তুলে দিলে মুদ্রানীতি কোনো কাজে আসবে না।’

বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলীর আলোচনার সূত্র ধরে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের দেওয়া সূত্র অনুসারে মুদ্রানীতি করা হয়েছে। এই মুদ্রানীতি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের পরিবেশ ব্যাহত করবে। এখনই শিল্পকারখানাগুলো ধুঁকছে, সক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশের মতো ব্যবহার করতে পারছে। নতুন মুদ্রানীতিতে সুদহার বাড়ানোর ফলে বেসরকারি খাত এখন আরও চাপে পড়বে।

এ পরিস্থিতিতে শিল্পমালিকেরা উদ্বিগ্ন এমন মন্তব্য করে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে সুদহার নিয়ে চাপ দেওয়া শুরু করেছে। রপ্তানি খাতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি না করা গেলে দেশে কর্মসংস্থানও কমে আসবে। এত কিছুর মধ্যে ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য চুক্তিকে একটা আশার আলো হিসেবে দেখা হচ্ছে। টাকায়ও বাণিজ্য করা যায় কি না সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। ডলারের দুই রকম দরের ফলে রপ্তানিকারকেরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানান তিনি।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ জোরালো ছিল। তাতে বেসরকারি খাতের জন্য সুদহারের চাপ বেড়েছে। তবে সরকারকে সব কিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুদহার অনেকটা বাজারভিত্তিক করতে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করা যাবে। সেটাই কিন্তু হবে সর্বোচ্চ সীমা। এখন ব্যাংকগুলো যদি এক বা দেড় শতাংশের মতো যোগ করে, তাহলে নতুন সুদের হার আগের ৯ শতাংশের আশপাশেই থাকবে।

সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাসে দেশের তৈরি পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখছেন না ফারুক হাসান। তিনি বলেন, এখন প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। তবে তহবিল সংগ্রহের খরচ বেড়ে গেলে নতুন বিনিয়োগ হবে না। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে। এমন সময় অনেকে বিনিয়োগ করতেও চান না। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব এখনো কাটেনি। তাই একটি রপ্তানি পণ্যের ওপর নির্ভর না করে পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আর তৈরি পোশাক খাতের জন্য নতুন বাজার দেখতে হবে।
চলতি বাজেটে রপ্তানি খাতের জন্য কিছু নেই বলে মনে করেন বিজিএমইএর সভাপতি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি শেষ পর্যন্ত একটা মুদ্রা–সম্পর্কিত ব্যাপার। আর মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্ব নীতির একটা সম্পর্ক আছে। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। এ বছরের মুদ্রানীতিতে প্রবৃদ্ধির চেয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।

তবে সুদহারের যে পরিবর্তন হয়েছে, তাতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। রপ্তানিমুখী খাতগুলোর জন্য প্রণোদনা চলমান রাখার পক্ষে মত দেন তিনি।

প্রথম আলোর অনলাইনপ্রধান শওকত হোসেন বলেন, ‘নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এটা আমাদের বোধোদয় থেকে হয়েছে। প্রশ্ন থেকে যায় যে আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্যই এগুলো করা হয়েছে কি না। তবে এটা ঠিক এবার মুদ্রানীতিতে একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতি পরিহার করে অর্থনীতিকে কীভাবে সামনে নিয়ে আসা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক অর্থসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মাহবুব আহমেদ, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) সিইও ফেরদৌস আরা বেগম, আইসিএবি সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান, আইসিএবির সাবেক সভাপতি জামালুদ্দিন আহমেদ, আইসিএবি সিইও শুভাশীষ বোস, ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি হ‌ুমায়ূন কবির।