শহরাঞ্চলে নারী শ্রমিক কমছে, গ্রামে গিয়ে কম বা বিনা মজুরিতে কাজ করছে

জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি ও শ্রমবাজারে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জবিষয়ক এক সংলাপে অতিথিরা। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে
ছবি: সংগৃহীত

দেশে গত পাঁচ বছরে সার্বিক কর্মসংস্থান বাড়লেও শহর এলাকায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। বিশেষ করে শিল্প খাতেই নারী শ্রমিক কমার প্রবণতা বেশি। এদের একটা অংশ গ্রামে ফিরে গিয়ে নিম্ন মজুরিতে কিংবা বিনা মজুরিতে গৃহস্থালি ও কৃষিকাজে যুক্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে দেশে বছরে ২০ লাখের মতো মানুষ শ্রমবাজারে এলেও তাদের মধ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় ১০ থেকে ১২ লাখের। প্রায় অর্ধেক শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান না হওয়ায় তা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য বড় বোঝা তৈরি করছে।

জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি ও শ্রমবাজারে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জবিষয়ক এক সংলাপে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। শ্রমসচিব মো. এহছানে এলাহীর সভাপতিত্বে সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক।

সংলাপে আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সচিব) মো. কাওসার আহমেদ; পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা সচিব শাহনাজ আরেফিন; অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান; আইএলওর প্রধান কার্যালয়ের কর্মসংস্থান, শ্রমবাজার ও যুব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শের ভেরিক, বাংলাদেশে সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিআইনেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও লেবার ফোর্স সার্ভের (এলএফএস) তথ্য পর্যালোচনা করে জানান, ২০১৭ সালে শহরাঞ্চলের কর্মসংস্থানে নারীদের হিস্যা ছিল ৩১ শতাংশ। তা ২০২২ সালে ২৩ দশমিক ৫৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান হারানো নারীদের একটা বড় অংশ গ্রামে ফিরে গিয়ে নিম্ন মজুরি বা মজুরি ছাড়াই পরিবারের কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে যুক্ত হয়েছেন বলে জানান অর্থনীতিবিদ এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, এটি অর্থনীতির জন্য কোনো ভালো লক্ষণ নয়।  

এম এ রাজ্জাক বলেন, ‘দেশে গত পাঁচ বছরে (২০১৭-২২) প্রায় ১ কোটির বেশি মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা ধনী দেশে পরিণত হওয়ার আগে বয়স্ক জাতিতে পরিণত হব।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান জানান, কর্মসংস্থান নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে চায় তাঁর মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে কর্মসংস্থান অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তিনি কাজ করছেন বলে জানান।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সচিব) মো. কাওসার আহমেদ বলেন, দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ আনুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত নেই। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে তারা ভবিষ্যতে বোঝা হয়ে যাবে।

বর্তমানে দেশের ৬০ শতাংশের বেশি লোক আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন না জানিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান বলেন, তারা বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রম দিচ্ছেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ জন্য প্রতিবছর দেশের অভ্যন্তরে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ ও প্রবাসে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমরা বছরে সব মিলিয়ে ১০–১২ লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছি। ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মক্ষম সব জনশক্তিকে শ্রমবাজারে যুক্ত করতে না পারলে আমরা মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে যাব।’

আইএলওর প্রধান কার্যালয়ের কর্মসংস্থান, শ্রমবাজার ও যুব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শের ভেরিক বলেন, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে শ্রমবাজারে বৈষম্য একটি প্রধান সমস্যা। বিশেষ করে এ অঞ্চলে বয়স্ক বেকারের তুলনায় তরুণ বেকারের সংখ্যা দুই–থেকে তিন গুণ বেশি। ফলে শুধু নীতি নয়, কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। চাহিদা অনুসারে দক্ষ কর্মী সরবরাহ করতে হবে।

বাংলাদেশে আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিআইনেন বলেন, নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবে না। আর সেই অংশগ্রহণ হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশি নারী–পুরুষের মজুরির ব্যবধান কমেছে। তবে নারীরা স্বল্পসংখ্যক পেশায় যুক্ত রয়েছেন। নারীদের জন্য কাজের বৈচিত্র্য বাড়ানো প্রয়োজন।

প্রশ্নোত্তর পর্বে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে, সঙ্গে উদ্বেগও বাড়ছে। টেকসই কর্মসংস্থানের পাশাপাশি টেকসই আয়ের বিষয়টিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’