রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ছে, সহযোগিতা জ্বালানিতেও 

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এক দশক আগেও ছিল ৭০ কোটি ডলারের। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে তা শতকোটি ডলারের বেশি থাকছে। 

রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং লেনদেন চালু করতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনা চললেও দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করতে হচ্ছে জার্মানি, পোল্যান্ড, তুরস্ক—এসব তৃতীয় দেশের মাধ্যমে। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে। একই সঙ্গে রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে জ্বালানি খাতে বড় ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রাশিয়ার অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে।

বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানিও। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উভয় দেশের বাণিজ্য শতকোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।

যার পরিমাণ ছিল ১১১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। এর পর থেকে প্রতিবছরই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শতকোটি ডলারের বেশি হচ্ছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে গেছে ২০ কোটি ডলারের মতো।

রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে গম, সার, লোহা, রাসায়নিক পণ্য, প্লাস্টিক, ইস্পাত ইত্যাদি। আর রাশিয়ায় রপ্তানি করে বস্ত্রপণ্য, চিংড়ি, পাট, সুতা, চামড়া, মোটর যন্ত্রাংশ, হোম টেক্সটাইল, টেরিটাওয়েল, ফুটওয়্যার, সিনথেটিক দড়ি, তৈজসপত্রের মতো পণ্য। 

বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আমরা নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছি। দেশটির মনোভাবও ইতিবাচক। উভয় দিক থেকেই কিছু কিছু সমস্যা আছে। এগুলো দূর করার ব্যাপারে আলোচনাও হচ্ছে। এক দশক আগের তুলনায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে, এটা আরও বৃদ্ধির সুযোগ আছে। তবে ব্যাংকিং লেনদেন না থাকাটা এখানে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।’

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ 

২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরের সময় তিনটি চুক্তি সই হয়। দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণবিষয়ক, আরেকটি বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে পারমাণবিক শক্তিসংক্রান্ত তথ্যকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে। 

রাশিয়ার অর্থায়নে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি আলাদা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে রাশিয়ার অর্থায়নের পরিমাণ ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার, যার ৯০ শতাংশই ঋণ। ঋণের সুদও উচ্চ, ৪ শতাংশ। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কাজ করছে রাশিয়ারই কোম্পানি। 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। রাশিয়া সরকারই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ দিয়েছে। ইউক্রেনে হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে এই প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধে তৈরি হয়েছে জটিলতা। কিস্তির অর্থ এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ হিসাবে রাখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ আর কী চায়

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ব্যাংকিং লেনদেন না থাকার পাশাপাশি রাশিয়ায় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে বড় সমস্যা উচ্চ শুল্ক। শুল্কায়ন জটিলতাও আছে। বাংলাদেশ চায় দেশটির সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন। রাশিয়ার ‘স্পুতনিক’ নামক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হবে—পাঁচ বছর ধরে এমন আলোচনা চললেও এখনো কোনো ফলাফল আসেনি।

এ ছাড়া রাশিয়া থেকে শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাওয়ার চেষ্টায় আছে বাংলাদেশ। এ সুবিধা পেতে ইউরেশীয় অর্থনৈতিক কমিশনের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারক করার চূড়ান্ত আলোচনা হয়ে আছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিষয়টি আর গতি পাচ্ছে না। 

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন চালুর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ব্যাংকিং লেনদেন থাকতে পারলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে লেনদেন হয় মূলত রুপি ও রুবলে।

রাশিয়ার যত বিনিয়োগ ইচ্ছা

মস্কোতে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য, অর্থনীতি, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয়ে আন্তসরকার কমিশন চুক্তি হয়েছে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর মস্কোতে বৈঠকও হয়েছে বাংলাদেশের। শেষ বৈঠক হয়েছে এ বছরের মার্চে ঢাকায়। কিন্তু কোনো প্রটোকল সই হয়নি।

গত মার্চে অনুষ্ঠিত আন্তসরকার কমিশনের চতুর্থ অধিবেশনে রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা নিজস্ব মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন করতে চায়। এ ছাড়া যৌথভাবে সার কারখানা, জ্বালানি পরিশোধন কারখানা এবং চামড়া ও চামড়াজাত কারখানাও স্থাপন করতে চায়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি খাতের জন্য গবেষণাগার তৈরিও রাশিয়ার আগ্রহের বিষয়। আবার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রকল্পে বাংলাদেশকে ঋণ দিতেও তারা ইতিবাচক।

এর বাইরে বাংলাদেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানি করতে চায় রাশিয়া। আগ্রহী বাংলাদেশে যৌথভাবে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) রপ্তানিতেও।

কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্টস স্টেট (সিআইএস)-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সভাপতি হাবিবউল্লাহ ডন প্রথম আলোকে বলেন, দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক যেহেতু ভালো আছে, তাই বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার বিকল্প নেই। আর ভারতের সঙ্গে যেহেতু ব্যাংকিং লেনদেন আছে, বাংলাদেশের সঙ্গেও তা হতেই পারে। শুধু এটি হলেই দুই দেশের বাণিজ্য বাড়বে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে যে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে দেশটির আরও বিনিয়োগ বাংলাদেশ আশা করতে পারে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, রাশিয়ার বাজার বড়। যদিও বাংলাদেশ এখনো বাজারটি ভালোভাবে ধরতে পারেনি। 

তবে কিছু ক্ষেত্রে সতর্কও থাকতে হবে বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে এখন চাপে রয়েছে রাশিয়া। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির রাজনীতিতে পটপরিবর্তন হলে এই ক্ষত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেই ঝুঁকিও মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশকে।