প্লাস্টিকের খেলনা থেকে শুরু করে শিল্পকারখানার কাঁচামাল কিংবা আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ হাজার হাজার পণ্য প্রতিদিন চীন থেকে আসছে। তাতে বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানির এক–চতুর্থাংশ অর্থই যাচ্ছে দেশটিতে। তার বিপরীতে চীনে বাংলাদেশের পণ্যের রপ্তানি প্রায় তলানিতে। যদিও দেশটিতে ৯৮ শতাংশ পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। সব মিলিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতিও সর্বোচ্চ পর্যায়েই রয়ে গেছে।
এদিকে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগও তুলনামূলক কম। মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ করেছেন চীনারা। তবে বাংলাদেশে চলমান বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে দেশটি। তার মধ্যে রয়েছে কঠিন শর্তের ঋণ। গত সাত বছরে চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। তার মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, শাহজালাল সার কারখানা, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি। ফলে বাণিজ্যের পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নেও চীন এখন বড় অংশীদার।
চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরে অন্য সম্পর্কও আছে। চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। চীনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষার কোর্স চালু করেছে। চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি প্রাদেশিক সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে।
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ায় ২০২৬ সালের পর চীনের বাজারে ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ।মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান
দীর্ঘ সময় ধরেই চীন বাংলাদেশের পণ্য আমদানির প্রধান উৎস। গত ১০ বছরে দেশটি থেকে আমদানি ৩ দশমিক ৮৩ গুণ বেড়েছে। তাতে পণ্য আমদানিতে চীনের হিস্যাও বাড়ছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানির সাড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে চীন থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে হয়েছে ২৭ শতাংশ।
চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করলেও দেশটিতে পণ্য রপ্তানিতে বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি ২০২০ সালের জুলাই থেকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও দেশটিতে রপ্তানি সেভাবে বাড়েনি। বর্তমানে দেশের মোট পণ্য রপ্তানির ১ দশমিক ২২ শতাংশের গন্তব্য হচ্ছে চীন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে চীন বাংলাদেশকে ৮ হাজার ৫৪৭টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানির সুযোগ দিচ্ছে। গত বছরের শুরুর দিকে এই তালিকায় আরও ১ শতাংশ বা ৩৮৩টি পণ্য যুক্ত হয়। তারপর আগস্টে নতুন করে ১ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি ছিল ৬০ কোটি ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটিতে বাংলাদেশ প্রায় ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। অর্থাৎ অধিকাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও দেশটিতে এ সময়ে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৮ কোটি ডলার।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীনের বাজারে ২৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। চীন বিশ্বের শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। তারপরও ১৪৫ কোটি মানুষের এই দেশ ২০২১ সালে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে। ফলে এই বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে। তবে তারা যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সে ধরনের পণ্য আমাদের রপ্তানির ঝুড়িতে নেই। আমাদের মূল রপ্তানি পণ্য পোশাক। আর পোশাকের বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। আবার চীন যেসব পোশাক আমদানি করে, তার মধ্যে অধিকাংশই বেশি মূল্যের ফ্যাশনেবল পণ্য। আমাদের উদ্যোক্তারা সেগুলো করেন না। সে কারণেই ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও চীনে আমাদের রপ্তানি বাড়ছে না।’
সদ্য চীন সফর করে এসেছেন নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনে শুধু তৈরি পোশাকের বাজার আছে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের। আমরা দেশে যে দামে পোশাক উৎপাদন করতে পারি, সে দামে চীনের স্থানীয় কারখানাগুলো পোশাক সরবরাহ করতে পারবে না। কারণ, তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। চীনে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে হলে ম্যান মেইড ফাইবারের (কৃত্রিম তন্তু) পোশাক উৎপাদনে আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। তাহলেই চীনে পোশাক রপ্তানির হিস্যা বাড়ানো আমাদের জন্য সহজ হবে।’
বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসার পরিমাণ এমনিতেই কম। তার মধ্যে চীনের অবস্থান সপ্তম। শীর্ষ ছয়ে আছে—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস ও হংকং।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) স্থিতির পরিমাণ ২ হাজার ২৪ কোটি ডলার। তার মধ্যে চীন থেকে এসেছে ৬ শতাংশ।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ৭৮১ একর জমিতে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। তবে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ইতিমধ্যে ৬০টি চীনা প্রতিষ্ঠান এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এতে যে জমি লাগবে, তা চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের মোট জমির ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে বিনিয়োগ আসবে ২৮ কোটি মার্কিন ডলার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ায় ২০২৬ সালের পর চীনের বাজারে ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। তারপরের বছরগুলোতে এই সুবিধা পেতে এখনই দেশটির সঙ্গে আলোচনা শুরু করা দরকার। তিনি বলেন, ‘দেশটির সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার ক্ষেত্রে আমাদের কৌশলী হতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, দর-কষাকষির মাধ্যমে ২০২৬ সালের পর আরও কয়েক বছর বর্তমান সুবিধা অব্যাহত রাখা। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ); তারা আমাদের শুল্কমুক্ত বাজার–সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে।’
মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, ‘চীনের মতো বড় বাজারে রপ্তানি বাড়াতে হলে ওই দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে। তারাই এখানে পণ্য উৎপাদন করে চীনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছে চীন। ফলে চীনা উদ্যোক্তাদের অনেকে অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ খুঁজবেন। সেই সুযোগটা আমাদের নেওয়া প্রয়োজন।’