আরও একটি বছর শেষ হচ্ছে। বছরটিতে দেশের অর্থনীতি নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। নেতিবাচক অনেক সংবাদের সঙ্গে কিছু সুসংবাদও ছিল। ২০২২ সালের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ২২টি আলোচিত ঘটনা নিয়ে এই আয়োজন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে সর্বশেষ ১০৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করলেও এখন ব্যাংকগুলো নিজেরাই দাম ঠিক করছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। চলতি বছর সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভ কমে আসে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে।
হঠাৎ আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খুলতে অনুমোদন নিতে হচ্ছে। শতাধিক পণ্যে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এতে কমে এসেছে আমদানির ঋণপত্র খোলা।
ইসলামী ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। একই কারণে সংকটে পড়ে ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ। আইএমএফের একটি দল গত নভেম্বরে ঢাকা সফরে এসে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা দিয়ে যায়।
অর্থনৈতিক সংকটেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সিপিডি ও পিআরআইয়ের পাশাপাশি এ নিয়ে সমালোচনামুখর ছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি ছিল বড় খলনায়ক। ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল গত আগস্টে—৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখনো মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের কাছাকাছি।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হয় গত ২৫ জুন। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পদ্মার ওপারের ২১ জেলার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়তে পারে। এতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
বিশ্ববাজারে এলএনজি ও জ্বালানির তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের সংকটের কারণে বছরের মাঝামাঝি সময়ে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট প্রকট হয়। বিপাকে পড়ে শিল্প খাত। উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েন অনেক উদ্যোক্তা।
সরকার গত আগস্টে প্রতি লিটার ডিজেলের ৩৪ টাকা, অকটেনের ৪৬ আর পেট্রলে ৪৪ টাকা মূল্য বৃদ্ধি করে। এতে পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ে। নিত্যপণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
এক বছরের ব্যবধানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে হারানো মুকুট ফিরে পায় বাংলাদেশ। ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আবার দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক।
তৈরি পোশাকের পর হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত এবং পাট ও পাটজাত পণ্য খাতের প্রতিটির রপ্তানি এ বছর ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পণ্য রপ্তানিতে ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। সেই সুবাদে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৫ হাজার কোটি ডলারের বা ৫০ বিলিয়নের মাইলফলক স্পর্শ করে।
ঢাকার নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুমোদন হয় আগস্টে। তাতে মধ্য ঢাকার কিছু এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণে উচ্চতা আগের চেয়ে কমবে। এতে সংকটে পড়েন ব্যবসায়ী ও জমির মালিকেরা।
এক বছরের বেশি সময় ধরে রডের দাম কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। আগস্টে রডের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছায়। দাম দাঁড়ায় টনপ্রতি ৯৩ হাজার টাকা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের বাজার সারা বছর অস্থির ছিল। গত জুনে দেশে প্রথমবারের মতো সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। লিটারপ্রতি দাম দাঁড়ায় ২০৫ টাকা। এরপরও বাজারে ছিল সংকট।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর হঠাৎ করেই ডিমের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। গত আগস্টে ঢাকার বাজারে ফার্মের মুরগির এক হালি ডিমের দাম ওঠে ৫০-৫৫ টাকা। দেশি হাঁস ও মুরগির ডিমের দর ওঠে প্রতি হালি ৬৫-৭০ টাকায়।
নিত্যপণ্যের অস্থিতিশীল বাজারে সয়াবিন তেলের চেয়ে বেশি চমক দেখিয়েছে আটা। বছরের শুরুতে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৩৪-৩৮ টাকা। এখন তা বেড়ে ৬০-৬৫ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। ফলে ভর্তুকি মূল্যে চাল ও আটা খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমে মানুষের সারি প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। মধ্যম আয়ের মানুষকেও লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।
চলতি বছরের শুরুটা মোটামুটি ভালোই ছিল। তবে শেষ ভাগে এসে মন্দাভাব দেখা দেয়। শেয়ারবাজারে পতন ঠেকাতে গত জুলাইয়ে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়। তাতে বছরের শেষ ভাগে এসে লেনদেন কমে তলানিতে নেমে আসে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ২৭ জুলাই জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২২ সালের শুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জনে।
সারা বছরে কয়েকবার সোনার দামে নতুন রেকর্ড হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল প্রতি ভরি সোনার দাম দাঁড়ায় ৮৭ হাজার ২৪৭ টাকায়; যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।