রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা শবনম জাহান মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি প্রতিদিন ৫০ টাকা রিকশাভাড়া দিয়ে অফিসে যেতেন। কিন্তু তিন দিন ধরে তাঁকে রিকশাভাড়া গুনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা। শবনম জাহান জানান, রিকশাচালকেরা এখন অতিরিক্ত গরমের কথা বলে বেশি ভাড়া চান।
প্রচণ্ড গরমে শুধু যাতায়াতের ভাড়াই নয়, নানা খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিগত খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত গরমের কারণে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে।
কয়েক দিন ধরে দেশে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। দেশের ৯০ শতাংশ এলাকাজুড়ে দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আপাতত গরম কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট ফিজ ডট ওআরজির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র তাপমাত্রার কারণে নির্মাণ ও কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে।
অধিক তাপমাত্রা বা দাবদাহে প্রাণহানির শঙ্কা থাকে। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিরা ক্লান্তি ও হিটস্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের ফলে সারা বিশ্বে ১ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
এর ফলে প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে এবং কিছুটা স্বস্তি পেতে মানুষ নানা রকম ভাবে চেষ্টা করেন। আর এসব কারণে আপনার ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। গরমের মধ্যে মানুষ ফ্যান বা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আগের চেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন। এর ফলে বিদ্যুতের খরচ বাড়ছে। শরীরকে শীতল রাখে, এমন খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণও বেড়েছে।
জীবনের হুমকি ছাড়াও প্রচণ্ড তাপমাত্রা অর্থনীতিতেও চরম প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি, উৎপাদন, খনিজ, খনন, পরিবহন ও নির্মাণের মতো খাতের অবদান ৫০ শতাংশের বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব খাতের শ্রমিকেরা উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করেন। তবে কী পরিমাণ শ্রমিক উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করেন, তার কোনো নির্ভরশীল পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু যাঁরা এ রকম উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করেন, তাঁরা গরমের সময় তুলনামূলক কম ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হন বলে দেখা যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৪৯টি জেলার ওপর দিয়ে এখন দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট ফিজ ডট ওআরজির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র তাপমাত্রার কারণে নির্মাণ ও কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে। অর্থাৎ, অবকাঠামো নির্মাণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং কৃষির ফলন কমে যেতে পারে।
প্রচণ্ড গরমে ভুট্টা, সয়াবিন ও তুলার মতো অনেক ফসলের ফলন কমে যায়। এর ফলে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি উৎপাদন কমার কারণে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের সংকট হলে মূল্যও বৃদ্ধি পায়। এতে আবার ভোক্তাদের ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রচণ্ড তাপমাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে দৈনিক কর্মঘণ্টা ২ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে, যা ৮ কোটি পূর্ণকালীন (ফুল টাইম) চাকরির সমতুল্য।
পণ্য পরিবহনেও প্রচণ্ড তাপমাত্রা প্রভাব ফেলে। যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ কোল্ড চেইন অবকাঠামো নেই, তাই পরিবহনের সময় প্রচণ্ড তাপে অনেক খাদ্যপণ্য নষ্ট হতে পারে।
গবেষণা বলছে, বেশি গরম আবহাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়, এমনকি তাঁরা যদি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও কাজ করেন। এর ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যায়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রচণ্ড তাপমাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে দৈনিক কর্মঘণ্টা ২ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে, যা ৮ কোটি পূর্ণকালীন (ফুল টাইম) চাকরির সমতুল্য। আর টাকার অঙ্কে তা ২৪ লাখ কোটি (২.৪ ট্রিলিয়ন) মার্কিন ডলারের সমান।
গত বছরে প্রকাশ করা একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় প্রচণ্ড গরমের কারণে কতটা আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আদ্রিয়ান আরশট-রকেফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের ওই গবেষণায় বলা হয়, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে কেবল ঢাকাতেই ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ শ্রম উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। এটি ঢাকার মানুষের মোট বার্ষিক শ্রমক্ষমতার ৮ শতাংশ।
সব মিলিয়ে ১২টি শহরের পরিস্থিতির সঙ্গে ঢাকার তুলনা করা হয়েছিলে ওই গবেষণায়। তাতে দেখা গেছে, গরমের কারণে শ্রমশক্তির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ঢাকায়। গবেষণায় অন্য যেসব শহর বিবেচনা করা হয়েছিল, সেগুলো হলো দিল্লি, এথেন্স, বুয়েনস এইরেস, ফ্রিটাউন, লন্ডন, লস অ্যাঞ্জেলেস, মিয়ামি, মনটেরি, সান্তিয়াগো ও সিডনি।
গরমের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টা আমাদের জন্য এক নতুন উপলব্ধি হয়ে আসছে। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করছি। কিন্তু এসব উন্নয়নকাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার দিকটি উপেক্ষা করে করা হয়।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রীষ্মের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে বৃদ্ধি পায়। এ সময় প্রতি ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দশমিক ১৫ থেকে দশমিক ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট প্রবৃদ্ধি কমে যায়।
গরমের মধ্যে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রকে (এসি) অনেকে সহজ সমাধান ভাবতে পারেন। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এসি ও অন্যান্য শীতলকরণ যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
তবে এর বিপরীত দিকও রয়েছে। অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে বিশ্বব্যাপী বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ খরচ ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। এখন এই বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আসে, তাহলে তা আবার তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
কিন্তু যেসব মানুষ উন্মুক্ত জায়গায় কাজ করেন, তাঁদের জন্য এসি কোনো সমাধান নয়।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে জীবনযাত্রার মান হ্রাসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘অস্বাভাবিক এই গরম ও এর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পেছনে আমাদের সম্মিলিত দায় রয়েছে।’
প্রথম আলোকে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘গরমের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টা আমাদের জন্য এক নতুন উপলব্ধি হয়ে আসছে। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করছি। কিন্তু এসব উন্নয়নকাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার দিকটি উপেক্ষা করে করা হয়। এর ফলে এখন দেখা যাচ্ছে, যে পরিমাণ উন্নতি হচ্ছে, তার একটি অংশ উল্টো অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
এ অবস্থায় ক্ষতি কমিয়ে আনতে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এই গবেষক বলেন, সরকারি, বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়েও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে করে সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
চলমান তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার জন্য বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি বলেছে, ধানের শিষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দুই-তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। আমগাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করা যেতে পারে।
এর ফলে গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী শবনমের মতো অনেক মানুষেরই ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এই প্রচণ্ড গরমে।