যেসব খেলাপি গ্রাহক নির্বাচন করছেন, তাঁদের কাছ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ আদায়ের পরামর্শ বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের।
‘দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে। আর এটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে এক দেশে দুই ধরনের সমাজ গড়ে উঠছে। এই বৈষম্য কমাতে হলে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। আর অর্থ পাচার এখন দাপ্তরিকভাবেও স্বীকৃত বিষয়।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ৬৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংস্থাটির মহাখালী কার্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এমন অভিমত দেন। তিনি ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজে অর্থায়নের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদহার চালুর পরামর্শ দেন।
সেমিনারে ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্য প্রবণতা এবং নিয়ামকসমূহ: সাম্প্রতিক প্রমাণ থেকে অন্তর্দৃষ্টি’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিনায়ক সেন। এতে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি ও ইউক্রেন সংঘাত দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তবে এর আগে গত এক দশকে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস। এতে সভাপতিত্ব করেন আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ।
বিনায়ক সেন খানা আয়–ব্যয় জরিপের সূত্রে বলেন, দেশে এখন গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৫০। শহরাঞ্চলে গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৫৪, আর গ্রামাঞ্চলে তা শূন্য দশমিক ৪৫। একই সঙ্গে দেশে ভোগের ক্ষেত্রেও অসমতা বেড়েছে। ২০২২ সালে দেশে জাতীয় পর্যায়ে ভোগ অসমতার ক্ষেত্রে গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৩৩৪; যা শহরাঞ্চলে শূন্য দশমিক ৩৫৬, আর গ্রামাঞ্চলে শূন্য দশমিক ২৯১।
প্রসঙ্গত, গিনি সহগের মান শূন্য হওয়ার অর্থ হলো, সমাজে চূড়ান্ত সমতা আছে। ১ হলে বুঝায় চূড়ান্ত অসমতা রয়েছে; আর শূন্য দশমিক ৫০ অতিক্রম করলে বুঝায়, দেশে উচ্চ অসমতা চলছে। অর্থাৎ দেশে উচ্চ অসমতা বিরাজ করছে।
এ পরিস্থিতিতে দেশে বর্তমানে যে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে, তা ঠিক এই অসমতা মোকাবিলা করার মতো নয়। অর্থাৎ বৈষম্যে তার তেমন একটা প্রভাব পড়ছে না, এমনটাই মনে করেন বিনায়ক সেন। তিনি ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের সূত্রে বলেন, তখন দেশের ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ছিল। তথ্যে দেখা যায়, গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মধ্যে এ নিয়ে বড় ব্যবধান আছে; গ্রামাঞ্চলের ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষার আওতায় থাকলেও শহরাঞ্চলে রয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ১ শতাংশ, যদিও শহরাঞ্চলে অসমতা বেশি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের তথ্য উপস্থাপন করে বিনায়ক সেন বলেন, সংসদ সদস্য, গুলশান ও ঢাকা ক্লাবের সদস্যদের পরিবারের সন্তানেরা উন্নত দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। আর অন্যরা বড় হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। ফলে এক দেশে দুই ধরনের সমাজ গড়ে উঠছে। দেশে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা নেই, এটাও একটা বড় সমস্যা।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিনায়ক সেন বলেন, ‘আমি প্রতি দুই সপ্তাহে গ্রামে যাই। সেখানে দেখেছি, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও গ্রামের মানুষের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। নেত্রকোনায় সুরাইয়া নামের একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি ৩ হাজার ৩০০ টাকায় সংসার চালাচ্ছেন।’
বিনায়ক সেন দারিদ্র্যের প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করে তা থেকে উত্তরণে বেশ কিছু নীতিগত প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি স্মার্ট সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা (এসএনএম), টেকসই প্রবৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে সেসব নীতি–প্রস্তাব বাস্তবায়নের সুপারিশ করেন।
বিনায়ক সেনের মতে, অর্থনীতি ও চিকিৎসা নিতে গিয়ে জনগণের বড় অংশ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যায়। এ জন্য তিনি আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার (ডলারের দাম), সুদহার ও দক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাপনা চালু; মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, চলতি হিসাবে উন্নয়ন এবং পরিমিত পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাখার পরামর্শ দেন।
আয় বৈষম্য কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে বিনায়ক সেন বলেন, গিনি সহগে উন্নতি করতে ছোট ও মাঝারিদের জন্য সহজে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদ্রদের অর্থায়নের জন্য দেশে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আছে। এখন ছোট ও মাঝারিদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এরপরই বিআইডিএসের মহাপরিচালক বলেন, ‘বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচার হচ্ছে, এটা এখন দাপ্তরিকভাবেও স্বীকৃত। এটা বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিতেই হবে। পাশাপাশি খেলাপি গ্রাহক যারা নির্বাচন করছে, তাদের থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ আদায় করতে হবে। এখন খেলাপি ঋণ চারবার পুনঃ তফসিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে, তা কমিয়ে দুইবারে নামিয়ে আনতে হবে। কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, যা সবাইকে খুশি করবে না।’
চিকিৎসা নিতে গিয়ে কত মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, এ–সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বিনায়ক সেন বলেন, ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার আশপাশে অবস্থান করে। চিকিৎসার খরচের কারণে এসব মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। এ জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে হবে।