দেশের চিংড়ি রপ্তানিতে অশনিসংকেত ‘পুশ’

ওজন বাড়াতে সিরিঞ্জের মাধ্যমে চিংড়ির শরীরে জেলি বা ভারী তরলজাতীয় দ্রব্য পুশ করছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী।

বাগেরহাটের একটি চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত হিমায়িত মৎস্য বা চিংড়ি রপ্তানি। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ওজন বাড়ানোর জন্য চিংড়ির ভেতরে বিভিন্ন অপদ্রব্য ঢুকিয়ে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পাঠাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ অপচেষ্টা ব্যাপক হারে বেড়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অভিযানে তা ধরাও পড়ছে।

চিংড়ি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, চিংড়িতে অপদ্রব্য ঢোকানোর ওই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘পুশ’। এ ধরনের প্রবণতা রপ্তানি খাতের জন্য অশনিসংকেত। আমদানিকারক দেশগুলোর কাছে যদি কখনো সেটি ধরা পড়ে, তাহলে বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে তারা। তখন রপ্তানি বাজার হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে খাতটি।

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি চিংড়ির ব্যাপক কদর ও চাহিদা রয়েছে কিন্তু সে তুলনায় উৎপাদন কম। এ কারণে জেনেশুনেই অনেক রপ্তানিকারক পুশ করা চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করছেন। গত বছরের মে মাসে মূলত চিংড়িতে পুশবিরোধী অভিযান শুরু করে খুলনা র‌্যাব-৬। এরপর ৮ মাসে ২৯টি অভিযান পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ সংস্থা। অভিযানে ১৩ হাজার ৬৩০ কেজি পুশ চিংড়ি জব্দ করা হয়। এই অপরাধে ৯০ জনকে জরিমানা করা হয়েছে ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা। আর ১৬ জনকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।

এর বাইরে জুলাইয়ে অভিযান শুরু করে খুলনা জেলা মৎস্য কার্যালয়। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৮০টি পুশবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে ৩৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জেলে পাঠানো হয়েছে ১১ জনকে। নষ্ট করা হয়েছে ৬ হাজার ১৮৮ কেজি চিংড়ি।

খুলনা র‌্যাব-৬–এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন, গত এপ্রিলে বিভাগীয় আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে চিংড়িতে জেলি পুশ করার ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়। তখন বিভাগীয় কমিশনার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য র‌্যাবকে অনুরোধ করেন। সে অনুযায়ী র‌্যাব অভিযানে নামে। মে মাস থেকে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জেলি পুশ করা অবস্থায় হাতেনাতেও অনেককে ধরা হয়েছে। র‌্যাব অধিনায়ক আরও জানান, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনার রূপসা এলাকার ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কাজে বেশি জড়িত বলে অভিযানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মৎস্য কর্মকর্তা, রপ্তানিকারক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর আগেও চিংড়ির শরীরে ছোট তারকাঁটা (লোহা) ঢুকিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে সেটি ধরা পড়ায় বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি কমে গিয়েছিল। ওই অপতৎপরতা বন্ধে মেটাল ডিটেক্টর বা ধাতব পদার্থ নির্ণয়কারী যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা শুরু হয়, তাতে ওই অপতৎপরতা বন্ধ হয়। এবার ওজন বাড়াতে চিংড়ির শরীরের মধ্যে সিরিঞ্জের মাধ্যমে জেলি বা বিভিন্ন ভারী তরলজাতীয় অপদ্রব্য পুশ করা হচ্ছে। রপ্তানির আগে বিভিন্ন ল্যাবের পরীক্ষায় জেলি ঢোকানোর ব্যাপারটি ধরা পড়ছে না।

ল্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, চিংড়ির মধ্যে জেলি হিসেবে যেটি প্রবেশ করানো হয়, আসলে তা হলো আগর নামের একধরনের পাউডার বা সাবু দানা। এগুলো পানির সঙ্গে মিশিয়ে কিছুক্ষণ আগুনে জ্বালালে ঘন জেলির মতো হয়ে যায়। পরে তা সিরিঞ্জের মাধ্যমে চিংড়ির মাথার দিকে ঢুকিয়ে বরফ ঠান্ডা পানিতে রাখা হয়। সঙ্গে সঙ্গে চিংড়ির শরীরের মধ্যে ওই জেলি জমাট বেঁধে শরীরের আকার ধারণ করে। তাই চিংড়ির খোলস ছাড়িয়ে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে না দেখলে তা বোঝা যায় না।

খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল প্রথম আলোকে বলেন, আগর বা সাবু শরীরের জন্য ক্ষতিকর কি না, তা নিয়ে কোনো গবেষণা বা পরীক্ষা এখনো হয়নি। তবে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কোনো কিছুর মধ্যে অন্য কিছু প্রবেশ করানো অপরাধ। তা ছাড়া চিংড়ির শরীরের মধ্যে থাকা অবস্থায় তা থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের জীবাণু সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়। যদি কখনো পুশ করা চিংড়ির ব্যাপারটি বিদেশিরা বুঝতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি নেওয়া বন্ধ করে দেবেন।

খুলনা চিংড়ি বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান মনজির বলেন, চাষি পর্যায়ে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয় না। কাজটি সাধারণত করা হয় ডিপো পর্যায়ে। তারা চাষিদের কাছ থেকে চিংড়ি কিনে শ্রমিকদের দিয়ে জেলি পুশ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পাঠায়। কারখানাগুলো জেনেশুনেই পুশ করা চিংড়ি কিনে থাকে। এসব কারখানা তাদের রপ্তানির চাহিদা পূরণ করার জন্যই কাজটি করে। কারখানাগুলো যদি পুশ করা চিংড়ি না কিনত, তাহলে এই অপতৎপরতা বন্ধ হয়ে যেত।

বিদেশে চিংড়ি রপ্তানির আগে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেয় মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। ওই বিভাগের খুলনার উপপরিচালক মো. আবু ছাইদ বলেন, চিংড়ির মধ্যে যে অপদ্রব্য পুশ করা হয়, তা আসলে রাসায়নিক নয়। এ কারণে তা পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। যদি কখনো পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তাহলে তা বাতিল করা হয়।