বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি

আপত্তির পরও ঋণ অনুমোদন শেখ আবদুল হাইয়ের ইচ্ছায়

চট্টগ্রামে দুদকের দুই মামলায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই, মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম ও তাঁর স্ত্রীসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র।

শেখ আবদুল হাই, সাবেক চেয়ারম্যান, বেসিক ব্যাংক
ছবি: বেসিক ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে

প্রায় ১৪ বছর আগে বেসিক ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ১৬৩ কোটি টাকার ঋণ পান জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম ও তাঁর স্ত্রী সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মেহজাবিন মোরশেদ। ঋণ মঞ্জুর না করতে ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটি আপত্তি দিলেও ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ঋণ মঞ্জুর করে দেন। পরে এক টাকাও পরিশোধ হয়নি। তাঁরা এখন খেলাপি। সুদসহ ব্যাংকের পাওনা এখন ৪০৮ কোটি টাকা।

এ ঘটনায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামে দায়ের হওয়া দুটি মামলার অভিযোগপত্রে এ অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতে জমা দেওয়া দুটি অভিযোগপত্রে মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম ও মেহজাবিন মোরশেদের পাশাপাশি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম সাজেদুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করা হয়।

শেখ আবদুল হাই ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়। চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাই দেওয়া হয় নিয়ম ভেঙে। এসব ঋণ কেলেঙ্কারির সময় ব্যাংকের এমডি ছিলেন কাজী ফখরুল ইসলাম।

গত ১২ জুন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ-সংক্রান্ত ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে শেখ আবদুল হাই ৫৮টিতেই আসামি। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামেও দুটি মামলা করে দুদক। মামলার দুটির একটি ৯২ কোটি টাকার ও আরেকটি ৭১ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ায় অনিয়মের।

অভিযোগপত্রে যা আছে

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকিং নামের জাহাজভাঙা কারখানার জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্যাংকে আবেদন করেন মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম। পুরোনো জাহাজ আমদানির জন্য ৬০ কোটি টাকার এলসি এবং ৫৭ কোটি টাকার এলটিআর (লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট বা বিশ্বাসের ঋণ) সুবিধার আবেদন করেন তিনি বেসিক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায়। আবেদনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শাখার তৎকালীন ঋণ কমিটি তাতে আপত্তি জানায়।

এরপর ২০১০ সালের ২৬৪তম পর্ষদ সভায় ঋণ প্রস্তাবনা উপস্থাপিত হয় এবং ৯২ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়। সুদে–আসলে গত জুন পর্যন্ত তা দাঁড়ায় ২০৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকায়। অভিযোগপত্রে শেখ আবদুল হাই, এ কে এম সাজেদুর রহমান এবং সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) শাহ আলম ভূঁইয়া ও ব্যবসায়ী মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীমের নাম রয়েছে।

অন্যদিকে আইজি নেভিগেশন নামের জাহাজভাঙা কারখানার এমডি মেহজাবিন মোরশেদের নামেও ৭১ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয় ২০১১ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত ২৯১তম পর্ষদ সভায়। গত জুন পর্যন্ত সুদে–আসলে এ ঋণ দাঁড়ায় ২০৪ কোটি ২ লাখ টাকায়। এ মামলায় আসামি করা হয় শেখ আবদুল হাই, সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম, সাবেক জিএম শাহ আলম ভূঁইয়া, মেহজাবিন মোরশেদ, পরিচালক হুমায়রা করিম ও সৈয়দ মোজাফফর হোসাইনকে।

দুদকের আইনজীবী কাজী ছানোয়ার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগামী আগস্টের শেষে আদালতে শুনানি শেষে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য আবেদন করা হবে।

দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম ও মেহজাবিন মোরশেদের বিরুদ্ধে দুদকের দুই মামলা ছাড়াও একই ঘটনায় চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতেও দুটি মামলা হয়। এ দুটি মামলায় চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি অর্থঋণ আদালত চট্টগ্রামের বিচারক মুজাহিদুর রহমান তাঁদের দুজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং আদালতে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁরা এখনো পাসপোর্ট জমা দেননি বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানান অর্থঋণ আদালত চট্টগ্রামের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম।

বেসিক ব্যাংকের এ দুই মামলা ছাড়া ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের করা ৩০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা খেলাপি ঋণের মামলায়ও গত ২১ জুন তাঁদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।

মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমকে মুঠোফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর আইনজীবী রফিকুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। লোকসানের কারণে এখন বেকায়দায় আছেন। সুদ মওকুফ করিয়ে ঋণগুলো পরিশোধের চেষ্টা করছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আদালতের নির্দেশে জব্দ করতে হবে, যাতে এগুলো তাঁরা বিক্রি করতে না পারেন।