কোম্পানিটির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, জামাতাসহ ৭ জনকে নিয়ে ১৮৮ কোটি টাকা সরিয়েছেন।
সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, জামাতাসহ ৭ জনকে নিয়ে কোম্পানির তহবিল থেকে ১৮৮ কোটি টাকা সরিয়েছেন। দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানির ওপর নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি এক বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। তাঁর ছক অনুযায়ীই সোনালী লাইফের তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠলে গত ৩১ ডিসেম্বর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) হুদা ভাসিকে নিরীক্ষক নিয়োগ করে। হুদা ভাসি সম্প্রতি নিরীক্ষা প্রতিবেদন আইডিআরএর কাছে জমা দিয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ যত বেশি এসবের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে, এ ধরনের ঘটনা তত কমবে। বিমাকারী ও পলিসি গ্রাহকদের স্বার্থে আইডিআরএর এবারের পদক্ষেপ ইতিবাচক মনে হচ্ছে।মাইন উদ্দিন, শিক্ষক, ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইডিআরএ ৪ এপ্রিল সোনালী লাইফের সব পরিচালক এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) জানায়, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও তাঁর সহযোগী কিছু পরিচালকের গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
আইডিআরএ জানায়, বিমাকারী ও বিমা গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে জরুরি ভিত্তিতে কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙে দিয়ে এতে প্রশাসক বসানো দরকার। বিদ্যমান পর্ষদের কোনো বক্তব্য থাকলে ১৭ এপ্রিলের মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে হবে। মৌখিক শুনানিতে ইচ্ছুক হলে সে সুযোগও তাঁরা পাবেন। তা হতে পারে ১৮ এপ্রিল বেলা ১১ টা।
পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির জন্য উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে প্রতিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ১ কোটি ৫ লাখ শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সোনালী লাইফ। বিএসইসি ২০১৮ সালের ১৪ জুন নগদ অর্থের বিনিময়ে এ শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেয়। আইডিআরএ বলেছে, কোম্পানিটির ২০ পরিচালকের মধ্যে ৭ জনই মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের। পর্ষদে পারিবারিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি অনিয়মের সুযোগ তৈরি করেছেন।
আইডিআরএর চিঠিতে আরও বলা হয়, একদিকে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের বড় মেয়ে কোম্পানির পরিচালক ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, বড় ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহানের স্ত্রী সাফিয়া সোবহান চৌধুরী, ছোট মেয়ে তাসনিয়া কামরুন আনিকার স্বামী শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল এবং পরিচালক নূর এ হাফজার কাছ থেকে কোনো টাকা না নিয়েই ৯ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার দেওয়া হয়। অন্যদিকে পরিচালক মায়া রাণী রায়, আহমেদ রাজীব সামদানী ও হোদা আলী সেলিমের কাছ থেকে দ্বিগুণ টাকা অর্থাৎ প্রতি শেয়ারে ২০ টাকা হারে নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে আইডিআরএর মুখপাত্র ও পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন সোনালী লাইফের অভিযুক্ত পরিচালকদের লিখিত বা মৌখিক জবাবের অপেক্ষা করছি। তাঁদের জবাব পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের ‘ইম্পিরিয়াল ভবন’ নামে একটি ভবন রয়েছে রাজধানীর মালিবাগে। ওই ভবনেই সোনালী লাইফের প্রধান কার্যালয়। ভবন কেনাবেচার জন্য এর মালিক ও সোনালী লাইফের মধ্যকার দুটি সমঝোতা চুক্তির কপি পায় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি। প্রথমটি চুক্তিটি হয় ২০২১ সালে, যাতে ভবনের দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২২ সালে সম্পাদিত দ্বিতীয় চুক্তিতে দাম বলা হয়েছে ১১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা। উভয় চুক্তির একটির বিষয়েও পর্ষদের কোনো অনুমোদন ছিল না।
অথচ জমি ও ভবন কেনা বাবদ অগ্রিম দেখিয়ে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে অবৈধভাবে ১৪১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সোয়েটার ক্রয়, আপ্যায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। চিঠিতে আইডিআরএ এসব কথা তুলে ধরেছে।
ইম্পিরিয়াল ভবনের জমির মালিকানা ও ভবন নির্মাণের অনুমতি যাচাইয়ের জন্য মূল দলিল, বায়া দলিল, খতিয়ান, নামজারি, ভূমিকর পরিশোধের রসিদ পায়নি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইডিআরএ বলেছে, ৭ কাঠা জমির ওপর ভবন নির্মাণের বরাদ্দপত্র, ইজারা চুক্তি ও ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেই। ফলে জমির মালিকানা নিষ্কণ্টক নয় ও ভবনের বৈধতাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
ইম্পিরিয়াল ভবনে ইম্পিরিয়াল ক্যাফে, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইম্পিরিয়াল স্যুট অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার, স্টার্লিং স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, রূপালী ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, ইম্পিরিয়াল হেলথ ক্লাব—এসব প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংক ছাড়া কারও কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়, এমন কোনো তথ্য পায়নি হুদা ভাসি।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনালী লাইফের ব্যাপারে আইডিআরএর চিঠি আমরা পেয়েছি। আমরাও আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’
আইনে কোম্পানির পর্ষদ বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য পরিচালকদের সম্মানী নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়ে, এক জামাতা, এক পুত্রবধূ ২ লাখ করে মাসে ১৪ লাখ টাকা বেতন নিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের বাইরে নূর এ হাফজাও মাসে দুই লাখ টাকা করে নিয়েছেন। এই আট পরিচালক এ যাবৎ বেতন বাবদ নিয়েছেন ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ কাজ তাঁরা করেছেন ১৪ মাস ধরে।
অবৈধভাবে বিলাসবহুল অডি কার কিনতে কোম্পানির তহবিল থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। আইডিআরএর প্রজ্ঞাপনে চেয়ারম্যানের জন্য সর্বোচ্চ ৮৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি কেনার কথা বেঁধে দেওয়া আছে।
পরিচালকেরা ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা অতিরিক্ত লভ্যাংশ ও ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা শিক্ষা ও ভ্রমণ ব্যয়ের জন্য নিয়েছেন। শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল গ্রুপ বিমা পলিসি থেকে অবৈধ কমিশন নিয়েছেন। একসময় তিনি যখন পরিচালক ছিলেন না তখন অবৈধভাবে ১১টি বৈঠকে অংশ নিয়ে সম্মানী নিয়েছেন। পরিচালক না হয়েও কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যৌথভাবে চেকে স্বাক্ষর করেন, যেসব চেকে ৩১ কোটি টাকা কোম্পানির তহবিল থেকে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে যায়। এ ছাড়া কোরবানির গরু কেনা, পলিসি নবায়ন উপহার, ঋণ সমন্বয়, অনুদান, এসি ক্রয় এবং প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) খরচের নামে নেওয়া হয়েছে ৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
ড্রাগন আইটি, ড্রাগন সোয়েটার ও ড্রাগন স্পিনিং নামে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের আলাদা কোম্পানি আছে। ড্রাগন আইটিকে অফিস ভাড়ার নামে দেওয়া হয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। পুরো ইম্পিরিয়াল ভবনের ইউটিলিটি বিল সোনালী লাইফ থেকে পরিশোধ করা হয় ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ড্রাগন সোয়েটার ও ড্রাগন স্পিনিংয়ের ১৪ লাখ টাকা করও দেওয়া হয় সোনালী লাইফের তহবিল থেকে।
যোগাযোগ করলে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরু থেকেই সোনালী লাইফ চলছে তাঁর ইম্পিরিয়াল ভবনে। যে টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, ভাড়ার টাকা সমন্বয় করলেও তা পূরণ হয়ে যাবে।’ কিছু ভুল-ভ্রান্তি থাকলেও বড় কোনো অন্যায় তিনি করেননি বলে দাবি করেন।
মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অন্য সব অভিযোগও অস্বীকার করেন।
আইডিআরএ বলেছে, বছরে গড়ে ২২ কোটি বা মাসে প্রায় ২ কোটি টাকা পেটি ক্যাশ হিসেবে ব্যয় হয়েছে এবং অনেক এককালীন বড় অঙ্কের লেনদেন নগদ চেকের মাধ্যমে হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অর্থ তছরুপের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ব্যাংক সিগনেটরি সবাই একই পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাঁদের স্বাক্ষরিত চেকের মাধ্যমেই বেশির ভাগ অবৈধ লেনদেন হয়।
ব্যক্তিগত ঋণ সমন্বয় বাবদ ২০১৬-১৮ সালে দুই বছরে ১১টি ভাউচারে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে ৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা নিয়েছেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, যা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। চেয়ারম্যানের কোরবানির গরু ও এতিমখানার জন্য গরু কেনার টাকাও নেন তিনি সোনালী লাইফ থেকে। এ ছাড়া আইপিও খরচের নামে অতিরিক্ত ১ কোটি টাকা নেন তিনি।
সোনালী লাইফের পুরো চিত্র তুলে ধরে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক মাইন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্ষদের প্রভাবশালী অংশের মাধ্যমে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের ঘটনা এর আগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফসহ কয়েকটা কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা গেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ যত বেশি এসবের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে, এ ধরনের ঘটনা তত কমবে। বিমাকারী ও পলিসি গ্রাহকদের স্বার্থে আইডিআরএর এবারের পদক্ষেপ ইতিবাচক মনে হচ্ছে।’