সোনালী লাইফের পর্ষদকে কেন বরখাস্ত করা হবে না, ব্যাখ্যা চেয়ে আইডিআরএর চিঠি

সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স
সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে কেন বরখাস্ত করা হবে না, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) তার ব্যাখ্যা চেয়েছে। এ ব্যাখ্যা চেয়ে কোম্পানির পর্ষদ চেয়ারম্যান কাজী মনিরুজ্জামান (স্বতন্ত্র পরিচালক) ও পরিচালক ইশরা তাহিয়াতকে গত বুধবার চিঠি দেয় আইডিআরএ। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ব্যাখ্যাটি দিতে হবে আগামীকাল সোমবারের মধ্যে, তা না হলে আইনগত ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি।

বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাখ্যা চাওয়া হয় বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়, সুষ্ঠু তদন্তের জন্য নিরীক্ষককে তথ্য সরবরাহ করেনি পর্ষদ। নিরীক্ষককে কোম্পানির কম্পিউটার ডেটাবেজ সিস্টেমেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি এবং কোম্পানির নথির মূল দলিল সরবরাহ করা হয়নি। তদন্ত চলাকালে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর রাশেদ বিন আমানকে অফিসে ঢুকতে না দিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তিনিসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনাগুলো তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল।

আইডিআরএর মুখপাত্র ও পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ব্যাখ্যার অপেক্ষায় আছি। সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

পরের পদক্ষেপ কি প্রশাসক নিয়োগ—এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সেটা এখনই বলা যাবে না।’

চিঠিতে বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘন করে আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে গ্রাহকের স্বার্থহানি ও কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ–সংক্রান্ত ১৪টি অভিযোগ তদন্তের জন্য আইডিআরএ গত ৩১ ডিসেম্বর নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়। অথচ সম্প্রতি পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের (যাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ) নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ ৩ জানুয়ারি সিইও রাশেদ বিন আমান অফিসে আসেন না—এমন অজুহাতে তদন্ত ২০ দিন বিলম্ব করার আবেদন করে। যদিও সিইও আইডিআরএর কাছে এক আবেদনে জানান, পর্ষদ চেয়ারম্যান ও অন্যদের মাধ্যমে তিনি অফিসে প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন এবং তাঁর অফিস তালাবদ্ধ।

২৩ জানুয়ারি হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি আইডিআরএর কাছে এক আবেদনে জানায়, কার্যপরিধি অনুযায়ী তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত সরবরাহ করা হচ্ছে না, কোম্পানির কম্পিউটার বেজ অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমে প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে না, সরবরাহকৃত ফটোকপির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য মূল দলিলপত্র দেওয়া হচ্ছে না এবং তদন্তকার্য পরিচালনায় পর্ষদ আশানুরূপ সহযোগিতা করছে না।

কেন নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়

আইডিআরএর কাছে তথ্য রয়েছে, কোম্পানির স্থায়ী হিসাবের (এফডিআর) বিপরীতে সাউথ বাংলা ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ওই হিসাব থেকে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও একই ব্যাংকে আরেক সঞ্চয়ী হিসাব থেকে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা তুলে নিয়ে চারজন পরিচালকের শেয়ার কেনার মূল্য পরিশোধ করা হয়।

আরও তথ্য রয়েছে, ২০২২ সালে কোম্পানির পর্ষদে পারিবারিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে একই পরিবারের চারজন সদস্যের নামে বিপুলসংখ্যক শেয়ার বিনা মূল্যে হস্তান্তর করা হয়। ২০২৩ সালে কোম্পানির বিদায়ী চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের ব্যক্তিগত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটারের জন্য প্রতি মাসে তিন কোটি টাকা কোম্পানির হিসাব থেকে জনতা ব্যাংকে পরিশোধ করা হয়।

এ ছাড়া মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন ভবন সোনালী লাইফের জন্য কেনার নাম করে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া এবং সে জন্য তিন বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বেশি সুদ নেওয়া হয়।

মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন ইম্পিরিয়াল ভবন কেনার জন্য ৩৫০ কোটি টাকায় সমঝোতা চুক্তি হয়। আইডিআরএর অনুমতি ছাড়াই দুই বছরে ইম্পিরিয়াল ভবনের মূল্য বাবদ মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ৫৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা নেন। একই সময়ে কোম্পানির তহবিল থেকে মোট ৬১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা সরিয়ে নেওয়া হয় মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

কোম্পানির পরিচালকেরা অবৈধভাবে মাসিক বেতনভাতা নিয়েছেন ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আইডিআরএর নির্দেশনা অমান্য করে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের জন্য কেনা হয় ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় বিলাসবহুল অডি গাড়ি। পরিচালকেরা কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশের অতিরিক্ত লভ্যাংশ গ্রহণ করেন। মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের বিদেশে চিকিৎসার যাবতীয় খরচ, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ভ্রমণ ও শপিং খরচ, বিদেশে পড়ালেখার খরচ অবৈধভাবে কোম্পানির তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়।

কোম্পানির পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ডেনিয়েল সোনালী লাইফের কার্যালয়ে ব্যক্তিগত অফিস পরিচালনা করেন। তিনি গ্রুপ বিমা পলিসি থেকে বড় অঙ্কের কমিশন পান। ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে পরিচালক না হয়েও পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণ করেন এবং সম্মানি-বোনাসসহ সব সুবিধা ভোগ করেন।

জানতে চাইলে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানিতে চিঠি এসেছে। যথাসময়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’ তবে অভিযোগগুলো যথাযথ নয় বলে তিনি দাবি করেন।

সোনালী লাইফ ২০১৩ সালে নিবন্ধন পাওয়া নতুন প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানি, তাদের শাখা আছে ২০৫টি। কোম্পানিটির বিমা গ্রাহক সাত লাখের বেশি। এজেন্ট আছে ৩০ হাজারের মতো, কর্মকর্তা-কর্মচারী ৮০০।