মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। লোকসানে পড়ে অনেকে মুরগির সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন।
দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই বাজারে ডিমের দাম বেড়ে যায়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। তবে কয়েক দিনের ব্যবধানে দাম আবার কমতে শুরু করেছে।
খামারিরা বলছেন, মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। লোকসানে পড়ে অনেকে মুরগির সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন। ফলে চাহিদার তুলনায় ডিমের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে ডিমের দাম বাড়ার সম্পর্ক নেই।
প্রশাসনের চাপাচাপির ও চাহিদা পড়ে যাওয়ায় তাঁরা ডিমের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছেন উল্লেখ করে খামারিরা আরও বলছেন, পোলট্রি খাত এখন ধ্বংসের মুখে। আগামীতে মধ্যস্বত্বভোগী কোম্পানির হাতে চলে যাবে ডিমের কর্তৃত্ব। তখন মানুষ তাদের নির্ধারিত দামেই ডিম কিনতে বাধ্য হবেন।
রাজশাহী শহরের একাংশসহ পবা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া ও চারঘাট উপজেলার কিছু এলাকার খামারিদের ডিমের আড়ত বাইপাস সড়কের মোসলেমের মোড়ে। ‘মোসলেমের মোড় ডিম আড়ত সমিতি’ সারা দেশের সঙ্গে মিল রেখে ডিমের দাম নির্ধারণ করে।
সমিতি সূত্র বলছে, গত ৬-৭ মাসে মুরগির খাবারের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজির) প্রায় ১ হাজার টাকা বেড়েছে। এরপর থেকে খামারিরা মুরগি বিক্রি করে দিচ্ছেন। এই অঞ্চলে প্রায় ১৭ লাখ ডিমপাড়া মুরগি ছিল। এখন তা নেমে এসেছে ৮ থেকে ৯ লাখে।
* ২০০৮ সালে ১ বস্তা খাবারের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, এখন তা ২ হাজার ৮০০। * একটি সাদা ডিমের উৎপাদন ব্যয় সাড়ে ৯ টাকা আর লাল ডিমের ১০ টাকা।
সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীনের ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন জানান, ডিমের সরবরাহ যখন কমে যায় ঢাকা, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসতে থাকে, ডিম লাগবে। চাহিদা বাড়ার কারণে দাম বেড়ে যায়। এর সঙ্গে তেলের দাম বাড়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। দীর্ঘদিন লোকসান দেওয়া খামারিরা মাত্র কয়েকটা দিন লাভের মুখে দেখেছিলেন। এরই মধ্যে সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে গেল।
বছরখানেক আগে ৭০ হাজার মুরগি ছিল পবা উপজেলার পারিলা গ্রামের খামারি ফরমান আলীর। এখন তাঁর মুরগি আছে ২০ থেকে ২৫ হাজার।
ফরমান আলী বলেন, ২০১৭ সালে ৩ টাকা ১০ পয়সা করে তাঁদের ডিম বিক্রি করতে হয়েছিল। তাঁরা ডিম ভেঙে প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু গণমাধ্যমে সেভাবে তা আসেনি। অথচ দাম দুই টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে গেল। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, প্রশাসন থেকে চাপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিমবিরোধী প্রচার শুরু হলো।
ফরমান আলী আরও বলেন, গতকাল শনিবার ডিমের দাম বেঁধে দেওয়া হয় ৮ টাকা ২০ পয়সা (সাদা) আর ৮ টাকা ৬০ পয়সা (লাল)। প্রতি ডিমে তাদের প্রায় দেড় টাকা করে লোকসান হচ্ছে বলে দাবি করেন এই খামারি।
অনেক খামারি ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন উল্লেখ করে ফরমান আলী আরও বলেন, ‘আগামীতে মধ্যস্বত্বভোগী কোম্পানি আসবে। তারা ডিমের যে দাম ধার্য করবে, সেই দামেই তাদের ডিম মানুষ কিনতে বাধ্য হবে।’
পবা উপজেলার মুরারীপুরের হাসিবুল আলমের খামারে ১৫ হাজার মুরগি রয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে ১ বস্তা খাবারের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, এখন ২ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ ডিমের দাম তখন থেকেই ছয় থেকে আট টাকার মধ্যে ঘুরছে।
হাসিবুল হিসাব দেন, গড়ে খামারের ৮০ ভাগ লাল ও ৮৫ ভাগ সাদা মুরগি ডিম দেয়। একটি মুরগি প্রতিদিন ৬ টাকা ৭২ পয়সার খাবার খায়। যেগুলো ডিম দেয় না একই পরিমাণ খাবার খায়। এসব যোগ করলে ডিমপ্রতি খাবারের ব্যয় হয় ৭ টাকা ৯২ পয়সা। এর সঙ্গে রয়েছে ওষুধ, কর্মচারীসহ নানা ব্যয়। সব মিলিয়ে একটি সাদা ডিমের উৎপাদন ব্যয় সাড়ে ৯ টাকা আর লাল ডিমের ১০ টাকা। সে অনুযায়ী প্রতিটি সাদা ডিমে লোকসান হচ্ছে ১ টাকা ৩০ পয়সা আর লাল ডিমে ১ টাকা ৪০ পয়সা।
দেশের ডিম উৎপাদনে শীর্ষে গাজীপুরের শ্রীপুর। সেখানকার খামারিরাও বলছেন, গত ৬-৭ মাসে পোলট্রি খাদ্যের দাম ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বেড়েছে ওধুষের দাম। বড় শিল্পপতিরা ‘সিন্ডিকেট’ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন।
প্রায় এক যুগ ধরে পোলট্রি ব্যবসা করছেন মাওনা ইউনিয়নের সিংগারদিঘী গ্রামের আমিনুল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডিমের বেঁধে দেওয়া মূল্য খামারিদের অনুৎসাহিত করবে। মুরগির খাবারের দাম কমালে কোনো অভিযান লাগবে না, এমনিতেই ডিমের দাম কমে যাবে। তাঁর অভিযোগ, সিন্ডিকেট এই শিল্পকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
শ্রীপুর পোলট্রি মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মতিন বলেন, ‘খাদ্যের দাম ১ টাকা কমান, ডিমের দাম ৫০ পয়সা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এত পরিশ্রম করে, পুঁজি খাটিয়ে আমরা লাভ করি ডিমপ্রতি ২৫ পয়সা, আর ঢাকায় আড়তদারেরা লাভ করেন প্রতি ডিমে ২ থেকে ৩ টাকা।’
টাঙ্গাইলের খামারিরাও হিসাব কষে দেখান, বর্তমান দরে ডিম বিক্রি করে তাঁদের লোকসান হচ্ছে। তাঁরাও অভিযোগ করেন, মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম দফায় দফায় ‘সিন্ডিকেট’ করে বৃদ্ধি করছেন বড় বড় ব্যবসায়ী।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, কালিহাতী, সখীপুর, সদর ও দেলদুয়ার উপজেলার অন্তত ২০ জন খামারির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, লোকসানের মুখে পড়ে অনেকেই খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। ঘাটাইলের মালিরচালা গ্রামের খামারি আরফান সিকদার জানান, গত ডিসেম্বরেও তাঁর খামারে ১৪ হাজার মুরগি ছিল। ডিম বিক্রি করে লোকসান হয়েছে। এখন রয়েছে তিন হাজার মুরগি।
আরফান সিকদার বলেন, গত সপ্তাহেও সাদা ডিম ১০ টাকা ৬০ পয়সা এবং লাল ডিম ১১ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। গতকাল (শনিবার) সাদা ডিম সাড়ে ৮ টাকা এবং লাল ডিম ৮ টাকা ৯০ পয়সা দরে বিক্রি করেছেন। এতে উৎপাদন খরচ উঠছে না।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আবদুল আউয়াল জানান, মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে পুরো পোলট্রি খাত হুমকির মুখে পড়বে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী, সাদিক মৃধা, শ্রীপুর, গাজীপুর ও কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল]