লিফটের বাজারে দেশীয় বিনিয়োগ

  • দেশে প্রতিবছর সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার লিফট বেচাকেনা হয়।

  • অর্ধেকের বেশি লিফট বিক্রি হয় ঢাকা শহরে।

  • ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পণ্য আমদানি করা।

  • বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের মতো।

  • লিফটপ্রতি গড় দাম ২০ লাখ টাকা ধরলে, বার্ষিক বাজার দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

  • ছোট-বড় মিলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আছে ২৫০ থেকে ৩০০।

  • দেশে তৈরি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫ হাজার কেজি ধারণক্ষমতার লিফট।

  • ২০২১ সালে লিফটের আন্তর্জাতিক বাজার ছিল ৯৯০০ কোটি ডলারের। ২০২৮ সাল নাগাদ হবে ১২০০০ কোটি ডলার।

গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটনের কারখানায় তৈরি হচ্ছে লিফট

একটা সময় ছিল পরিবারের সঙ্গে বৃদ্ধ মা-বাবা বা বাসায় অসুস্থ কেউ থাকলে লিফট আছে এমন বাসায় থাকার চিন্তা করা হতো। কিন্তু নগরজীবনের নানান ব্যস্ততার কারণে এখন তিন-চারতলায় বসবাসের ক্ষেত্রেও সিঁড়ি মাড়িয়ে ওঠার ধকল অনেকে নিতে চান না। এ জন্য লিফট আছে এমন ভবনে বাসা ভাড়া খোঁজেন। তাই এখন আধুনিক ভবন নির্মাণ হলে, সেখানে লিফটের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। আবার বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে একাধিক লিফটের ব্যবস্থা অহরহ দেখা যাচ্ছে। এতে দেশে লিফটের বাজার দ্রুত বড় হচ্ছে।

বহুতল ভবনে নির্বিঘ্ন ওঠানামার জন্য যে যন্ত্রটির কথা বলছি, তার ইংরেজি নাম এলিভেটর। দেশের মানুষের কাছে যন্ত্রটি ‘লিফট’ নামেই বহুল প্রচলিত। দেশের বাজারে প্যাসেঞ্জার, হাসপাতাল, ক্যাপসুল, কার্গো, এস্কেলেটর—এই পাঁচ ধরনের লিফট রয়েছে। এসব লিফট ব্যবহৃত হচ্ছে বাসাবাড়ি, বহুতল বিপণিবিতান, হাসপাতাল ও শিল্পকারখানায়। তবে বর্তমানে প্যাসেঞ্জার লিফটের পাশাপাশি কার্গো লিফটের চাহিদাও বাড়ছে।

দেশের লিফটের বাজারের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। তবে সম্ভাবনাময় এ খাতে দেশীয় বিনিয়োগ আসতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে তারা বাজার দখল করছে, তবে এখনো বাজারে দেশীয় কোম্পানির হিস্যা অনেক কম। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওয়ালটন লিফট উৎপাদনে বড় বিনিয়োগ করেছে। ২০১৯ সালে লিফটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে ইলেকট্রনিক খাতের শীর্ষস্থানীয় এই প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ তিন দশকের বেশি সময় ধরে লিফট আমদানি করে। ২০২০ সালে লিফট সংযোজন ও উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপন করেছে তারা। ‘প্রোপার্টি লিফট’ ব্র্যান্ড নামে লিফট বাজারজাত করছে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এই শিল্পগোষ্ঠী।

আমদানিকারক ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বর্তমানে প্রতিবছর সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার লিফট বেচাকেনা হয়। তার অর্ধেকের বেশি বিক্রি হয় ঢাকায়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহীতেও লিফটের বড় বাজার রয়েছে। ঢাকার পূর্বাচল আবাসন প্রকল্প ও দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পকারখানা নির্মাণ শুরু হলে লিফটের বাজারে আরও গতি আসবে বলে মনে করেন তাঁরা।

দেশে মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ লাখ থেকে কোটি টাকার লিফট পাওয়া যায়। প্রতিটি লিফটের গড় দাম ২০ লাখ টাকা ধরলে দেশে লিফটের বাজার কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকার। তার মধ্যে ৮৫-৯০ শতাংশ আমদানি করা। বাকিটা দেশের দুই কোম্পানি উৎপাদন করছে।

দেশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও লিফটের চাহিদা বাড়ছে। আমেরিকান গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল মার্কেট ইনসাইটসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে লিফটের বাজার ছিল ৯ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২৮ সাল নাগাদ এই বাজার বেড়ে ১২ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়াবে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের বিল্ডিং ও নির্মাণ খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ।

আমদানি করা লিফট

দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় লিফট আমদানিকারক কোম্পানি মান বাংলাদেশ লিমিটেড। এ ছাড়া ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, ইলেকট্রোমেক টেকনিক্যাল অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, রওশন এলিভেটরস লিমিটেড, সিবাটেক করপোরেশন, নগর এলিভেটরস, খান ব্রাদার্স ইক্যুই-বিল্ড লিমিটেডসহ ২৫০-৩০০টি প্রতিষ্ঠান লিফট আমদানি করে। তবে সব ধরনের নিয়মনীতি মেনে লিফট আমদানি, বাজারজাত ও বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়ে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে এমন প্রতিষ্ঠান গোটা দশেক।

জানা যায়, শিন্ডলার, মিতসুবিশি, ওটিস, হুন্দাই, সিগমা ও থাইসেনকুর্প ব্র্যান্ডের লিফট বেশি আমদানি হচ্ছে। এসব লিফট মূলত চীন, কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে।

আমদানিকারকেরা বলছেন, প্রতিবছরই লিফটের বাজার বড় হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণকাজ যত বাড়বে, লিফটের ব্যবহারও তত বাড়বে। তার প্রমাণ হচ্ছে ১০ থেকে ১২ বছর আগে লিফটের বাজার ছিল ২০০ কোটি টাকার আশপাশে। তা এখন প্রায় হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে খান ব্রাদার্স ইক্যুই-বিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তোফায়েল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত লিফটের বাজার বাড়ছে। কিন্তু কোলন (বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে জোড়া) লিফটের ব্যবহার থামাতে হবে। তাহলে লিফটের ব্যবহার নিরাপদ হবে। নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় ব্র্যান্ডের লিফট বসানো দরকার এবং পরে এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি।

আশা দেশীয় বিনিয়োগে

১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে ইলেকট্রনিকসের বাজারে যাত্রা শুরু করে ওয়ালটন। লক্ষ্য ছিল একসময় দেশেই কারখানা করা। ওয়ালটনের উদ্যোক্তা প্রয়াত এস এম নজরুল ইসলাম সে লক্ষ্য পূরণে বেশি সময় নেননি। ২০০৫ সালের শেষ দিকে ওয়ালটন গাজীপুরের কালিয়াকৈরে জমি কিনে কারখানার কাজ শুরু করে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে। সেই ফ্রিজের বাজারে সিংহভাগ দখলে নিয়ে নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি টেলিভিশন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), কম্পিউটার ও ল্যাপটপ, মুঠোফোন, গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিক পণ্য, এলইডি বাতি ইত্যাদি তৈরি করে ওয়ালটন

গাজীপুরের চন্দ্রায় নিজেদের কমপ্লেক্সে ২০১৯ সালে লিফট উৎপাদনেও নাম লেখায় ওয়ালটন। লিফট পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সম্প্রতি কারখানা চত্বরে ১৫ তলাবিশিষ্ট লিফট টেস্টিং টাওয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বছরে ৮০০ থেকে ৮৫০টি লিফট বানানোর সক্ষমতা আছে।

ওয়ালটনের কর্মকর্তারা জানান, লিফট উৎপাদন শুরুর তিন বছরের মধ্যে বাজার হিস্যার ১০-১২ শতাংশ দখলে নিয়েছে তারা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি ১৫ শতাংশে উন্নীত হবে। আর আগামী পাঁচ বছরে লিফটের বাজারে ৫০ শতাংশ দখল করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। ভবিষ্যতে বিদেশের বাজারে রপ্তানির পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।

প্রাণ–আরএফএলের লিফট

প্রতিষ্ঠানটির লিফট বিক্রয় বিভাগের প্রধান মো. জেনান-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ৪৫০ কেজি থেকে শুরু করে ৫ হাজার কেজি ধারণক্ষমতার লিফট তৈরি করছে ওয়ালটন। ভবিষ্যতে স্মার্ট টেকনোলজির লিফট নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। ক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে লিফট নিলে প্রদর্শনী কেন্দ্রে এসে, নির্ধারিত ভবনে (টাওয়ার) পরীক্ষার মাধ্যমে লিফট যাচাই করে নিতে পারবেন। এসব লিফট কিস্তিতেও বিক্রি করা হচ্ছে।

প্রয়াত আমজাদ খান চৌধুরী ১৯৮১ সালে ৪২ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ওই বছরই শুরু করেছিলেন ফাউন্ড্রি বা টিউবওয়েল তৈরি ও আবাসন ব্যবসা। তবে আবাসন ব্যবসা তিনি বেশি দিন করেননি। ফাউন্ড্রির ব্যবসায় নজর বেশি দেন। প্রতিষ্ঠা করেন রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল)। যার আওতায় এখন বহু ধরনের পণ্য রয়েছে। তবে আমজাদ খান চৌধুরীর লক্ষ্য ছিল কৃষির ব্যবসায় নামা। তারই অংশ হিসেবে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যাগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিডেট, প্রাণ। বর্তমানে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

১৯৮৮ সাল থেকে ইউরোপ থেকে লিফট আমদানি করে বাজারজাত করত প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। নরসিংদীর পলাশে নিজেদের ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ২০২০ সালে লিফট সংযোজন ও উৎপাদনের জন্য কারখানা করে তারা। বর্তমানে আমদানির পাশাপাশি সংযোজন ও লিফটের বেশ কিছু অংশ উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।

গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিফটের বাজার ধরতে আমরা বিনিয়োগ করেছি। তাতে আমাদের প্রত্যাশা, লিফট উৎপাদনে মূল্য সংযোজন ও বাজার হিস্যা বাড়বে। বর্তমানে আমাদের বাজার হিস্যা ১০ শতাংশের মধ্যে।’ তিনি জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠান যত লিফট বিক্রি করে, তার মধ্যে ৮০ শতাংশ সংযোজন ও নিজেদের উৎপাদিত। বাকি ২০ শতাংশ লিফট প্রস্তুতকৃত অবস্থায় আমদানি করা।

মানের বিষয়ে কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘আমরা লিফটের ব্যবসায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করছি। ধীরে ধীরে আরও উন্নত করার জন্য কাজ করছি। ফলে মানুষের মধ্যে এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা বাড়ছে। আশা করছি, লিফটের বাজারেও দেশীয় কোম্পানিগুলো ভালো করবে।’

লিফট উৎপাদনে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ এলিভেটর এস্কেলেটর ও লিফট আমদানিকারক সমিতির সভাপতি এমদাদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আসা মানেই এ শিল্পের সম্ভাবনা ভালোভাবে চিহ্নিত হলো। এখন আরও প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আসার জন্য যে ধরনের নীতিসহায়তা প্রয়োজন, সরকারকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ভারী শিল্প হওয়ায় এ খাতে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। সুতরাং স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংকঋণ পাওয়া না গেলে অনেকের জন্য এত ভারী শিল্প স্থাপন সম্ভব হবে না।’

নেই তদারকি সংস্থা

ভবনের বাসিন্দাদের ওঠানামার জন্য ব্যবহৃত লিফটের ফিটনেস বা নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন হবে, তা নিয়ে নেই বিশেষ কোনো তদারকি সংস্থা। এ জন্য অনেক আমদানিকারক শুধু মোটর ও গতিনিয়ন্ত্রক (স্পিড কন্ট্রোলার) দেশে এনে অন্য যন্ত্রাংশ সংযোজন করে লিফট তৈরি করে। আর এই মানহীন লিফটের কারণে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনার কথাও শোনা যায়।

বিষয়টি নিয়ে লিফট আমদানিকারক সমিতির সভাপতি এমদাদুর রহমান বলেন, ‘এটি একটি টেকনিক্যাল ইকুইপমেন্ট। তবে এ বাজার তদারকিতে কোনো সংস্থা নেই। আমরা চাই সরকারের পক্ষ থেকে এটা তদারকি করা হোক। তাহলে ক্রমবর্ধমান এই ব্যবসা একটা সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আসবে।’