প্লাস্টিক ও মুদ্রণশিল্প নগর

আট বছরেও হলো না জমি অধিগ্রহণ

উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে এর স্থান নির্বাচন ও জমি প্রাপ্তি চূড়ান্ত করার নির্দেশনা থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই নিয়ম মানা হয় না।

বিসিক
বিসিক

রাজধানীর পুরান ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা প্লাস্টিক কারখানাগুলো সরিয়ে নিতে সরকার ২০১৫ সালে প্লাস্টিক শিল্প নগরের প্রকল্প নেয়। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই মেয়াদ চারবার বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে কেটে গেছে আট বছর। অথচ এখনো জমি অধিগ্রহণের কাজই শেষ হয়নি। একই অবস্থা চলছে ২০১৬ সালে নেওয়া মুদ্রণশিল্প প্রকল্পের।

প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, প্লাস্টিক শিল্প নগর স্থাপনে প্রাথমিকভাবে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বড়বর্ত্তা মৌজায় ৫২ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে বিসিককে জমি অধিগ্রহণের অনুমতি দেয়। এরপর জেলা প্রশাসনকে ২১৮ কোটি টাকা দেয় সংস্থাটি। প্লাস্টিক শিল্প নগরের পাশেই ৪৩ একর জায়গায় মুদ্রণশিল্প নগর স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে প্রাথমিকভাবে ৯০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে বসতি থাকায় শেষ পর্যন্ত কোনো প্রকল্পেরই জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

প্রকল্প বাস্তবায়নে বর্তমানে আর কোনো জটিলতা নেই। ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সম্প্রতি আলোচনা হয়েছে। তারা দ্রুত এ কাজ শেষ করবে। আর উন্নয়ন কাজের দরপত্র আহ্বানসহ অন্যান্য কাজও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
সঞ্জয় কুমার ভৌমিক, চেয়ারম্যান, বিসিক

পরবর্তী সময়ে উভয় প্রকল্পের জন্য সিরজদিখান উপজেলার খারসুর মৌজায় জায়গা নির্ধারণ করে বিসিক। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, খারসুর মৌজায় কোনো বসতি নেই। সেখানকার জমির দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় আগের চেয়ে জমির পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। এবার প্লাস্টিক শিল্প নগরের জন্য ৯৫ একর ও মুদ্রণশিল্প নগরের জন্য ১০০ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়।

জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে বর্তমানে আর কোনো জটিলতা নেই। ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সম্প্রতি আলোচনা হয়েছে। তারা দ্রুত এ কাজ শেষ করবে। আর উন্নয়নকাজের দরপত্র আহ্বানসহ অন্যান্য কাজও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

চার দফায় বেড়েছে মেয়াদ

বিসিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বিসিক প্লাস্টিক শিল্প নগর প্রকল্পটি পাশ হয়। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের জুনে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কোনো কাজ এগোয়নি। এ জন্য চার দফায় ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি শেষ করার জন্য ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, ‘প্লাস্টিক শিল্প নগরের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বলে এলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। তবুও আমরা অপেক্ষায় রয়েছি। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, দ্রুত যেন শিল্পনগরটি বাস্তবায়ন করা হয়। পাশাপাশি সেখানে জমির দাম যেন সাধ্যের মধ্যে রাখা হয়।’ 

মুদ্রণশিল্প নগরের মেয়াদও চার দফা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত আরেক দফা মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে।

খরচও বেড়েছে

প্রকল্পের মেয়াদের পাশাপাশি খরচ বাড়ানো হয়েছে। যেমন প্লাস্টিক শিল্প নগর প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩৩ কোটি টাকা, যা পরবর্তী সময়ে দফায় দফায় বাড়ানোর ফলে এখন ৫০৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ খরচ বেড়েছে প্রায় চার গুণ।

মুদ্রণশিল্প নগর প্রকল্পের খরচ ১৩৮ কোটি টাকা থেকে প্রথমে ২৬৪ কোটি টাকায় এবং পরে আরও বাড়িয়ে ৪৪৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। বিসিক কর্মকর্তারা বলছেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি) রেট শিডিউল পরিবর্তন হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

সর্বশেষ অবস্থা

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, প্লাস্টিক শিল্প নগর প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন করেছে। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমতি পেয়ে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য গত সপ্তাহে জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে বিসিক। আর মুদ্রণশিল্প নগর প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া গত নভেম্বর মাসে শুরু হয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিকের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, উভয় প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ হতে ছয় মাস লাগতে পারে। এরপর জমি ভরাট ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ শেষে উদ্যোক্তাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে।

নিয়ম না মানায় এ অবস্থা

উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে এর স্থান নির্বাচন ও জমি প্রাপ্তি চূড়ান্ত করার বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই নিয়ম বিসিকের ক্ষেত্রে মানা হয়নি। ফলে প্রকল্প নেওয়ার পরে জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে জটিলতায় পড়েছে সংস্থাটি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প তৈরির আগে স্থান নির্বাচন ও জমি প্রাপ্তি চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু এ নিয়ম মানা হয় না। এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। জমি অধিগ্রহণের জটিলতা এড়াতে প্রকল্পের বিষয়গুলো শুরু থেকে স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।