আগর-আতর তৈরির কাজ করছেন একদল নারী শ্রমিক। সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর গ্রামে
আগর-আতর তৈরির কাজ করছেন একদল নারী শ্রমিক। সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর গ্রামে

তিন কারণে আগর-আতর উৎপাদনে ভাটা

মৌলভীবাজারের বড়লেখার সুজানগর গ্রাম আগর-আতরের আঁতুড়ঘর নামে পরিচিত হলেও এ ব্যবসা এখন আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, কাঁচামালের সংকট ও রপ্তানিতে কম প্রণোদনার কারণে সুগন্ধি তরল আতরের উৎপাদন কমে গেছে। এসব আগর-আতর মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের দেশসহ জাপান ও চীনে রপ্তানি হয়। সুজানগরের আগর-আতর সম্প্রতি জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে।

গত সোমবার সরেজমিন সুজানগর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, রোজার মধ্যে এই গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে শ্রমিকেরা ব্যস্ত আগর-আতর প্রক্রিয়াকরণের কাজে। কারও নিজস্ব কারখানা, কারও বাড়ির উঠান-বারান্দায় লোহার পেরেক মারা আগরগাছ ফালি ফালি করে কেটে কালো ও সাদা অংশ আলাদা করা হচ্ছে। গাছে পেরেক মারা স্থানে কালো রঙের আগর জমা হয়। কারও বাড়িতে স্টিলের পাতিলে আগরকাঠ থেকে তরল আতর উৎপাদিত হচ্ছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত আগর-আতর উৎপাদন চলে। এ সময়টা শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় গাছ থেকে সহজে আগর সংগ্রহ করা যায়। ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুছের বাড়িতে ১০-১৫ জন শ্রমিক আগরগাছ কেটে কালো অংশ আলাদা করছিলেন। আবদুল কুদ্দুছ জানান, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে আতর উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার তরল আতর রপ্তানি করেন। তিনি মূলত সৌদি আরব ও কুয়েতে সুগন্ধি আগরকাঠ রপ্তানি করেন। প্রতি চালানে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা পাওয়া যায়।

সুজানগরের আগর-আতরের পুরোনো ও বড় ব্যবসায়ী আনছারুল হক। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ। তিনি বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। আলাপকালে আনছারুল হক বলেন, পূর্বপুরুষদের আমল থেকে তাঁরা আগর-আতর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সুজানগরে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে এ ব্যবসা চলছে। শুধু সুজানগরেই ছোট-বড় অন্তত ৩০০ আগর-আতর ব্যবসায়ী রয়েছেন। একসময় শুধু সুজানগরেই আগর-আতর উৎপাদন হতো। এখন আশপাশের অনেকেই এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

আগরগাছ

আনছারুল হক বলেন, বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন আগরবাগান রয়েছে। কৃত্রিমভাবে আগর সংগ্রহের জন্য বাগানমালিকেরা গাছে পেরেক মেরে রাখেন। কৃত্রিম এ পদ্ধতিতে পেরেকের চারপাশে কালো রঙের আগর জমা হয়। ব্যবসায়ীরা বাগানমালিকদের কাছ থেকে আগরগাছ কিনে নেন; কিন্তু সেটা সংখ্যায় অনেক কম। অনেক স্থানে বন বিভাগ তাদের জমিতে সামাজিক বনায়নের আওতায় আগরবাগান করেছে। আগরকাঠ কিনতে নিলামে অংশগ্রহণের জন্য ২০১৬ সালে ৩০ থেকে ৪০ জন আগর-আতর ব্যবসায়ী বন বিভাগের লাইসেন্স নেন। বন বিভাগই তাঁদের এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ সামাজিক বনায়নের গাছগুলো পরিপক্ব হলেও অনেক দিন ধরে নিলাম হচ্ছে না। নিলাম হলে তাঁরা গাছ কিনতে পারতেন। তাতে কাঁচামালের সংকট দূর হতো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগর-আতর রপ্তানিতে ৮ শতাংশ প্রণোদনা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এ খাতের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, খরচ যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে আগর–আতর রপ্তানির প্রণোদনাও বাড়ানো দরকার।

ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে আগর-আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, একসময় বছরে ১৫০ কোটি টাকার আগর-আতর বিদেশে রপ্তানি হতো। গত কয়েক বছরে তা কমে ১০০ কোটি টাকার নিচে নেমেছে। আগর থেকে পাওয়া সুগন্ধি আতরই শুধু রপ্তানি হয় না। আগরকাঠ ও বর্জ্যও রপ্তানি হয়ে থাকে। দেশে কোনো কাজেই আগর-আতর ব্যবহার করা হয় না।

এ খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা জানান, আগর-আতর শ্রমঘন শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ জড়িত। পরোক্ষভাবে এ সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। কয়েক বছরে শ্রমিকদের মজুরি, উৎপাদন খরচও বেড়েছে। বর্তমানে এ শিল্পে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। অথবা চা-শিল্পের মতো এ শিল্পের জন্য প্রতি ঘনফুট গ্যাসের দাম ১১ দশমিক ৯৩ টাকা নির্ধারণ করতে হবে।

২০১২ সালের আগর নীতিমালা অনুযায়ী, সামাজিক বনায়নের আওতায় বিভিন্ন এলাকায় করা আগরবাগানের গাছ কর্তনের বিষয়ে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর।