২০২৬ সালের মধ্যে এসব শিল্পনগরী বাস্তবায়ন করতে চায় বিসিক। এ জন্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
■ বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১ জেলায় বিসিকের ২১টি শিল্পনগরী রয়েছে।
■ গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে আছে দুটি করে শিল্পনগরী।
■ ২১ জেলার মধ্যে শিল্পনগরী নেই মাগুরা ও নড়াইল জেলায়।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে প্রায় ২ হাজার ৪০০ একর জায়গায় সাতটি নতুন শিল্পনগরী করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব শিল্পনগরী বাস্তবায়ন করতে চায় তারা। এ জন্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে বিসিক। প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে, এর মাধ্যমে ১০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১ জেলায় বিসিকের ২১টি শিল্পনগরী রয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে আছে দুটি করে শিল্পনগরী। ২১ জেলার মধ্যে শিল্পনগরী নেই মাগুরা ও নড়াইল জেলায়। এই দুই জেলায় দুটিসহ মোট সাতটি নতুন শিল্পনগরী স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বিসিক।
প্রস্তাবিত নতুন শিল্পনগরীগুলো হচ্ছে ফরিদপুরের নগরকান্দা শিল্পপার্ক, যশোরের ফাউন্ড্রি, অটোমোবাইল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পপার্ক, মাদারীপুরের শিবচর শিল্পপার্ক, নড়াইল শিল্পপার্ক, মাগুরা শিল্পপার্ক, পিরোজপুর শিল্পপার্ক ও শরীয়তপুরের জাজিরা শিল্পপার্ক।
তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিসিকের শিল্পনগরীতে শিল্পপ্লট খালি পড়ে আছে। আবার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার দিক থেকেও পিছিয়ে আছে অনেক বিসিকি শিল্পনগরী। ফলে নতুন করে এসব শিল্পনগরী গড়ে তোলা হলে সেখানে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য কতটা
আগ্রহী হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই নতুন করে শিল্পনগরী গড়ে তোলার আগে এ বিষয়ে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হয়েছে। এ কারণে মানুষ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আরও বেশি আগ্রহী হবেন। সেই চিন্তা থেকেই নতুন সাতটি শিল্পনগরী স্থাপনের পরিকল্পনা করছি আমরা।’
বিসিক জানিয়েছে, দেশে ফাউন্ড্রি বা ঢালাই শিল্প, হালকা প্রকৌশল ও অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অন্যতম বড় কেন্দ্র হচ্ছে যশোর জেলা। এসব প্রতিষ্ঠান যাতে পরিবেশবান্ধব শিল্প এলাকায় গড়ে উঠতে পারে, সে জন্য যশোরে ৪১০ একর জায়গায় শিল্পপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিসিক। সেখানে শিল্পপার্ক চালু হলে দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
প্রস্তাবিত ফরিদপুর বিভাগীয় শহরকে কেন্দ্র করে জেলার নগরকান্দায় ৫০০ একর জায়গায় শিল্পপার্ক স্থাপন করতে কার্যক্রম শুরু করেছে বিসিক। এখানে শিল্পপার্ক চালু হলে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বিসিক বলছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এ কারণে শিবচরে প্রায় ৩৫০ একর জায়গায় মাল্টিসেক্টরাল শিল্পপার্ক করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তারা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এখানে প্রায় দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
খুলনা অঞ্চলের অপর দুই জেলা মাগুরায় ১৯৪ একর ও নড়াইলে ৩৫০ একর জায়গায় দুটি শিল্পপার্ক স্থাপন করতে চায় বিসিক। এতে দুই জেলায় প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। বরিশাল বিভাগের জেলা পিরোজপুরে প্রায় ৩১০ একর জায়গায় একটি শিল্পপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই শিল্পনগরী বাস্তবায়িত হলে প্রায় দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছে বিসিক।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, ছয়টি শিল্পনগরী স্থাপনে ইতিমধ্যে ফরিদপুর-সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে জমিপ্রাপ্তির সম্মতিপত্র পেয়েছে বিসিক। এরপর প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে তা শিল্প মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। পরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) তা পাস হলে শিল্পনগরী বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।
এ ছাড়া শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় জাজিরা শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বিসিক। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে ৩০০ একর জায়গা চেয়েছে তারা। এখানে শিল্পনগরী হলে প্রায় দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছে বিসিক।
আগের শিল্পনগরীগুলো ছোট জায়গায় হলেও পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক যেসব শিল্পনগরীর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর জন্য বেশি পরিমাণে জমি বরাদ্দ চাচ্ছে বিসিক। যেমন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩০ একর জায়গায় বরিশাল শিল্পনগরী করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রস্তাবিত এক মাগুরা জেলাতেই প্রায় ১৯৪ একর জায়গায় শিল্পপার্ক স্থাপন করতে চায় বিসিক। বাকিগুলো হবে ৩০০ একরের বেশি জায়গায়।
তবে অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বিসিকের প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। নতুন প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিল্পনগরীর পরিকল্পনা এখনো প্রস্তাব পর্যায়ে আছে। একনেকে অনুমোদনের পরে সময়সীমা সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে বলা যাবে। তখন সে অনুসারে আমরা কাজ বাস্তবায়ন করব।
বিসিকের পরিকল্পিত শিল্পনগরী সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বিসিকের শিল্পনগরীর ইতিহাস খুব সুখকর নয়। ফলে নতুন শিল্পনগরীগুলো কার্যকর করতে হলে বিসিককে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এ ছাড়া সরকার দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে, সেগুলোর সঙ্গে শিল্প নগরীর সমন্বয় কীভাবে হবে, পরিষেবা কেমন হবে, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও অর্থায়ন কীভাবে হবে, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। বিশেষ করে অর্থায়ন জোর দেন তিনি; কারণ ব্যাংকগুলো ওই অঞ্চলে অর্থায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল হতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সেলিম রায়হানের পর্যবেক্ষণ, শিল্প মন্ত্রনালয়ে দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে। তারা এখনো সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্য পরিশোধনাগারের কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। ফলে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের নতুন শিল্পনগরীগুলো বাস্তবায়ন করতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।