সরকারি চিনিকলগুলো অকার্যকর থাকায় দেশে চিনির চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে জোগান দেয় বেসরকারি কোম্পানিগুলো।
দেশে চিনির বাজারে কয়েক মাস ধরেই সংকট চলছে। সরকার খুচরা পর্যায়ে চিনির যে দাম বেঁধে দিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। অথচ ব্যাপক চাহিদার এ সময়েও বাজারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না সরকারি চিনিকলগুলো। উল্টো এসব চিনিকলের উৎপাদন কমার পাশাপাশি লোকসানের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
বাজারে বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত প্যাকেটজাত চিনি (সাদা চিনি) প্রতি কেজির দাম সরকার ১১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) আওতাধীন কারখানাগুলোর উৎপাদিত মোড়কজাত দেশি চিনির (লাল চিনি) দামও একই।
দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে চিনিকলগুলোর আজকের এ অবস্থা হয়েছে। সরকার বছরের পর বছর এসব কারখানা পরিচালনায় ভর্তুকি দিচ্ছে। এতে করদাতাদের কষ্টার্জিত টাকার অপব্যয় হচ্ছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
সরকারি চিনিকলগুলো অকার্যকর থাকায় দেশে চিনির চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে জোগান দেয় বেসরকারি কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধন করার পর বাজারে ছাড়ে। ফলে বাজারে চিনির দামের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণও থাকছে তাদের হাতে।
জানতে চাইলে বিএসএফআইসির সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার বলেন, ‘শুধু এক মৌসুমের উৎপাদন খরচ হিসাব করলে বর্তমানে বাজারে বেশি দামেই চিনি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ঋণের বোঝাসহ সার্বিক খরচের কারণে সরকারি চিনিকলগুলোকে লোকসানেই থাকতে হচ্ছে।’
দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে বিএসএফআইসির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা মাত্র ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৮০ টন। কিন্তু চলতি মৌসুমে উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ১৬ শতাংশ বা ২১ হাজার ৩১৩ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করতে পেরেছে সংস্থাটি, যা মোট চাহিদার দেড় শতাংশের কম। গত এক দশকে সরকারি মিলগুলোতে চিনি উৎপাদন কমেছে প্রায় ৭৭ শতাংশ। আগে ১৫টি সরকারি মিলে চিনি উৎপাদন হতো। অব্যাহত লোকসানের কারণে ২০২০ সালে ৬টি মিলের কার্যক্রম স্থগিত করে সরকার।
নাটোরের লালপুরের নর্থবেঙ্গল চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মাড়াই মৌসুমে আখের দাম বাড়িয়ে প্রতি মণ ১৮০ টাকা করা হয়। কিন্তু গুড় ব্যবসায়ীরা আরও বেশি দামে আখ কিনে নেওয়ায় মিলগুলোতে চিনির উৎপাদন কম হয়েছে।
গত এক দশকে বিএসএফআইসির অধীনে থাকা জমিতে আখ চাষের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। ফলে আখ উৎপাদন, মাড়াই ও চিনি উৎপাদনও কমেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫টি সরকারি মিলে চিনি উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন। এক দশক পর, অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে ৯টি চিনিকলে মাত্র ২৪ হাজার ৫১০ টন চিনি উৎপাদিত হয়, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম।
এদিকে সরকারি চিনিকলগুলোর উৎপাদিত চিনির সামান্য অংশই পৌঁছায় সাধারণ ভোক্তাদের কাছে। কারণ, সরকারের চিনি বিক্রি ও বণ্টন নীতিমালা অনুসারে সরকারি মিলগুলোতে উৎপাদিত চিনির উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যয় হয় সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংরক্ষিত খাতে।
এর বাইরে নিবন্ধিত সরবরাহকারীর মাধ্যমে বাজারে যে চিনি যায়, তা ভোক্তারা কিনতে পারেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সুপারশপ ও বিএসএফআইসির নিজস্ব বিপণনকেন্দ্রে অল্প কিছু প্যাকেটজাত চিনি ভোক্তাদের জন্য বিক্রি করা হয়।
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন প্রতিবছরই বিপুল অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি প্রায় ৬২৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা লোকসান দেয়। এর আগের অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা।
বিএসএফআইসি বলছে, বাজারে হিস্যা বাড়াতে তাই পরিশোধিত চিনি আমদানির পরিকল্পনা করছে তারা। পাশাপাশি বন্ধ মিলগুলো চালুর জন্য নতুন বিনিয়োগও খোঁজা হচ্ছে।
সংস্থাটির সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার জানান, বর্তমানে সুদসহ ৯ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ রয়েছে বিএসএফআইসির।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে চিনিকলগুলোর আজকের এ অবস্থা হয়েছে। সরকার বছরের পর বছর এসব কারখানা পরিচালনায় ভর্তুকি দিচ্ছে। এতে করদাতাদের কষ্টার্জিত টাকার অপব্যয় হচ্ছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
এ ব্যাপারে তিনি চারটি পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে কিছু চিনিকল বন্ধ করা, কিছু বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া, কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারি মালিকানায় রেখে ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে দেওয়া এবং কোনো কোনোটি শেয়ারবাজারে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। একটি কমিশন গঠন করে সেটির মাধ্যমে ভালোভাবে পর্যালোচনা করিয়ে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।