ছাতক সিমেন্ট কারখানা

নতুন কারখানার চাকাও ঘুরছে না

নির্মাণ শেষে অলস পড়ে আছে ৯০০ কোটি টাকার কারখানা। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে এখন গ্যাস-সংযোগ লাইন বসাতে প্রকল্প সংশোধনের উদ্যোগ।

৯০০ কোটি টাকায় নির্মিত ছাতক সিমেন্টের নতুন কারখানাটি অলস পড়ে আছে গ্যাস–সংযোগ ও কাঁচামালের অভাবে। সম্প্রতি তোলা ছবি
আনিস মাহমুদ

সুনামগঞ্জে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ছাতক সিমেন্ট কোম্পানির সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কারখানার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। চাইলে চলতি বছর উৎপাদনে যেতে পারবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন কারাখানাটি। কিন্তু কারখানা নির্মাণ শেষ হলেও গ্যাস সরবরাহের লাইন স্থাপন করা হয়নি। এ ছাড়া সিমেন্টের কাঁচামাল হিসেবে ভারত থেকে পাথর আমদানি ও আমদানির রোপওয়ে (পাথর আনার পথ) তৈরি নিয়েও রয়েছে জটিলতা। আর তাতে ৯০০ কোটি টাকায় তৈরি নতুন এ কারখানা এখন অলস বসে আছে।

কারখানার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হলেও এরই মধ্যে এই প্রকল্পের ব্যয় আরেক দফা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকায় উন্নীত করা ও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সাল পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে সব জটিলতা কাটিয়ে আদৌ ২০২৫ সালের মধ্যে পাথর আমদানি, রোপওয়ে ও গ্যাসলাইন নির্মাণ শেষ হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন কারখানা তৈরির কাজ শেষ। কিন্তু রোপওয়ে, গ্যাসলাইনসহ অন্যান্য কাজ বাকি থাকায় প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৮৮ ভাগ।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এত অর্থ ব্যয়ে কারখানা করে এখন গ্যাস-সংযোগের অভাবে ও অন্যান্য কারণে অলস পড়ে থাকলে বিপুল এই বিনিয়োগ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার সময়মতো উৎপাদনে না গেলে কারখানার যন্ত্রপাতিতেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

‘সব সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। আগেই নেতিবাচক চিন্তা করলে হবে না।’ রোপওয়ে নির্মাণ ও পাথর আমদানির প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি দল সম্প্রতি ভারতে গিয়েছিল। ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এসেছে। আশা করি অনুমতি পাওয়া যাবে।’
সাইদুর রহমান, বিসিআইসির চেয়ারম্যান

উৎপাদন বাড়াতে ছাতক সিমেন্ট কোম্পানির উৎপাদন পদ্ধতি ওয়েট প্রসেস থেকে ড্রাই প্রসেসে রূপান্তরকরণে ২০১৬ সালে ৬৬৭ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি)।

পরে সেই খরচ বাড়িয়ে করা হয় ৮৯০ কোটি টাকা। এখন আবার নতুন করে এ খরচ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। ছাতক সিমেন্ট কারখানা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিসিআইসির একটি প্রতিষ্ঠান।

বিসিআইসির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। আগেই নেতিবাচক চিন্তা করলে হবে না।’ রোপওয়ে নির্মাণ ও পাথর আমদানির প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি দল সম্প্রতি ভারতে গিয়েছিল। ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এসেছে। আশা করি অনুমতি পাওয়া যাবে।’

‘রোপওয়ে নির্মাণের অনুমতির জন্য আমরা এরই মধ্যে ভারত ঘুরে এসেছি। তবে এখনো আমরা অনুমতি পাইনি। আশা করছি শিগগিরই অনুমতি পেয়ে যাব।’
আবদুর রহমান, প্রকল্প পরিচালক

গ্যাস-সংযোগ লাইন

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা ছাতক উপজেলায় সুরমা নদীর তীরে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাতক সিমেন্ট কারখানা। জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম এত দিন ছাতক অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের মূল লাইন থেকে এ কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করত। কিন্তু নতুন কারখানায় যে পরিমাণ গ্যাস লাগবে, তা এ লাইন থেকে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই কারখানাটি চালু করতে গ্যাস সরবরাহের জন্য আলাদা সংযোগ লাইন লাগবে। কিন্তু কারখানাটি স্থাপনে যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে গ্যাসলাইন স্থাপনের বিষয়টি ছিল না। সর্বশেষ প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর যে প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেখানে ৪৩ কিলোমিটার নতুন গ্যাসলাইন স্থাপনের জন্য ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

গ্যাসলাইন স্থাপনের বিষয়টি প্রকল্পের শুরুতে কেন রাখা হয়নি, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারিগরি কমিটি ভেবেছিল, আগে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হতো, তা দিয়েই উৎপাদন চালু করা যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেটি সম্ভব নয়। আগে আমাদের ৬-৭ এমএমসিএফ গ্যাস লাগত, এখন লাগবে ১৪ এমএমসিএফ।’

এদিকে প্রকল্প তৈরির সময় গ্যাসলাইন স্থাপনের বিষয়টি না রাখাকে প্রকল্পের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

কারখানাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, শুরুতে ছাতক সিমেন্ট কারখানার উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল দৈনিক সর্বোচ্চ ৫০০ মেট্রিক টন। যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ায় কারখানা বন্ধ হওয়ার আগে সর্বোচ্চ ১০০-১৫০ মেট্রিক টন সিমেন্ট উৎপাদন করতে পারত। এতে কারখানাটিতে গ্যাসও কম লাগত। আধুনিকায়নের ফলে এখন কারখানাটি দৈনিক দেড় হাজার মেট্রিক টন ক্লিংকার উৎপাদন করতে পারবে।

নতুন প্রযুক্তির কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ করে এখন চালু না করলে নতুন যন্ত্রপাতি ধীরে ধীরে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে। কর্মচারীদের বসিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার চাপও রয়েছে। তাই বিকল্প উপায়ে কারখানা চালু করে লাভজনক করার পথ খোঁজা যেতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক

পাথর আমদানি, রোপওয়ে নির্মাণ

এত দিন ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোমোরাহ লাইমস্টোন মাইনিং কোম্পানি (কেএলএমসি) থেকে চুনাপাথর আমদানি করা হতো ছাতক সিমেন্ট কারখানার জন্য। সেই পাথর আসত মেঘালয় থেকে। ২০২০ সালের মার্চে করোনার সময় ভারত চুনাপাথর রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে কারখানাটি পাথরের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও ভারত সরকার সে দেশে কেএলএমসি নিবন্ধন নবায়ন না করায় প্রতিষ্ঠানটি থেকে চুনাপাথর আমদানিও বন্ধ হয়ে যায়যদিও এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত পাথর আমদানির চুক্তি ছিল ছাতক সিমেন্ট কারখানার। এখন চুনাপাথর আমদানির বিষয়টি নির্ভর করছে কেএলএমসির অনুমোদন পাওয়ার ওপর।

ভারতের কেএলএমসি থেকে রোপওয়ের (খুঁটি পুঁতে তারের মাধ্যমে পথ তৈরি করে পাথর আনার পদ্ধতি) মাধ্যমে পাথর আমদানি করত ছাতক সিমেন্ট। এই রোপওয়ের ১১ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশে। ভারত অংশে রয়েছে ৫ কিলোমিটারের একটু বেশি। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নতুন কারখানার জন্য যে পরিমাণ পাথর প্রয়োজন হবে, তা আগের রোপওয়ে দিয়ে আনা সম্ভব নয়। আবার বাংলাদেশ অংশের রোপওয়ে ইতিমধ্যে ভেঙে বিক্রিও করে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে রোপওয়ে নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পে থাকলেও ভারতের অনুমতি না পাওয়ায় সেটির কাজই এখনো শুরু হয়নি।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবদুর রহমান গত আগস্টে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোপওয়ে নির্মাণের অনুমতির জন্য আমরা এরই মধ্যে ভারত ঘুরে এসেছি। তবে এখনো আমরা অনুমতি পাইনি। আশা করছি শিগগিরই অনুমতি পেয়ে যাব।’

ছাতকের পুরোনো কারখানার বিষয়ে কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন কারখানাটি বন্ধ থাকায় পুরোনো যন্ত্রপাতি অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো দিয়ে এখন আর উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব নয়।

আবার ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব

নতুন করে গ্যাসলাইন স্থাপনের জন্য সংশোধিত প্রকল্পটি এখনো অনুমতি না পেলেও বিসিআইসি আশা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে সেই লাইন স্থাপন সম্ভব হবে। শুধু তা-ই নয়, রোপওয়ে নির্মাণ শুরু না হলেও ২০২৫ সালের মধ্যে সেটির কাজও শেষ হবে; অর্থাৎ ছাতক সিমেন্টের আধুনিক কারখানাটির উৎপাদন যেসব কারণে চালু করা যাচ্ছে না, সব কটি সমস্যার সমাধান ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে হয়ে যাবে বলে আশাবাদী বিসিআইসি।

 প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু সেটি হয়নি, তাই মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত করা হয়। সেই মেয়াদও ইতিমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। এখন তৃতীয়বারের মতো প্রকল্পের মেয়াদ আবার বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের খরচও আরেক দফা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে নতুন প্রস্তাব পাঠিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

এ অবস্থায় ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি আদৌ শেষ হবে কি না এবং নতুন কারখানাটি উৎপাদনে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ কারখানাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে। তাঁরা বলছেন, উৎপাদন শুরুতে যত দেরি হবে, ৯০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের কারখানাটির যন্ত্রপাতিও পুরোনো হতে থাকবে। ফলে এ বিনিয়োগের সুফল কবে মিলবে এবং কতটা মিলবে, তা বলা মুশকিল।

প্রকল্পের শুরু থেকে সব বিষয় মাথায় না রাখার কারণে এখন এ জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নতুন প্রযুক্তির কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ করে এখন চালু না করলে নতুন যন্ত্রপাতি ধীরে ধীরে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে। কর্মচারীদের বসিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার চাপও রয়েছে। তাই বিকল্প উপায়ে কারখানা চালু করে লাভজনক করার পথ খোঁজা যেতে পারে।