গত মাসে পণ্য রপ্তানি কমলেও সার্বিকভাবে তা ইতিবাচক ধারায় আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ৫.৩৮%।
দেশে প্রবাসী আয়ের পর রপ্তানি আয়ও কমল। কমার হারও একই। ডলার-সংকটের মধ্যেই সদ্য সমাপ্ত এপ্রিল মাসে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান দুটি উৎসেই ধাক্কা লাগল। এর আগে টানা দুই মাস প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় কমেছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে।
সাধারণত ঈদের মাসে প্রবাসী আয় অন্য সময়ের তুলনায় বেশি আসে। কিন্তু এবার ঈদের মাস এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬৮ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ কম। অন্যদিকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের কারণে মাসের শেষ ১০ দিন অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ছিল। এ সময় কারখানা থেকে রপ্তানি পণ্য বন্দরে যায়নি বললেই চলে। ফলে এপ্রিলে পণ্য রপ্তানি কমে হয় ৩৯৬ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কম।
গত মাসে পণ্য রপ্তানি কমলেও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিলে সার্বিকভাবে তা ইতিবাচক ধারায় আছে। এ সময়ে মোট ৪ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের তুলনায় ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডলারের বিনিময় মূল্যে বড় ধরনের সমন্বয় আনতে হবে। সেটি কষ্টদায়ক হলেও করতে হবে। একটু একটু করে সমন্বয়ে সাময়িক স্বস্তি হয়তো আসবে, তবে টেকসই কিছু হবে না। কারণ, ডলারের বাজারদর বেশি।মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, চেয়ারম্যান, র্যাপিড
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল বুধবার পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক পণ্য ও চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমেছে।
পণ্য রপ্তানির ৮৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। তবে একক মাস হিসেবে এপ্রিলে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৫ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৩৩৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের এপ্রিলে ছিল ৩৯৩ কোটি ডলার।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এপ্রিলে তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমবে সেটি অনুমেয় ছিল। কারণ দুটি। এক. ঈদের ছুটির কারণে ২০ এপ্রিলের পর অধিকাংশ কারখানাই ৮-১০ দিন বন্ধ ছিল। দুই. কারখানাগুলোতে ক্রয়াদেশ ৩০-৪০ শতাংশ কম ছিল। তারপরও বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেটুকু রপ্তানি হয়েছে, সেটিকে খারাপ বলা যায় না।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল ছিল দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য। যদিও চলতি অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানিতে ধস নেমেছে। আলোচ্য ১০ মাসে ৯৪ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ শতাংশ কম।
এ নিয়ে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুল্লাহ জোবায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে হোম টেক্সটাইলের ক্রয়াদেশ গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম। আগামী ডিসেম্বরের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এমন পূর্বাভাসই দিচ্ছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে গেছে। অন্যদিকে ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দাভাব চলছে। ফলে আমরা বহুমুখী চাপে জর্জরিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত টিকে থাকতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
হোম টেক্সটাইলের মতো পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ধুঁকছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৭৭ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। গত মার্চ পর্যন্ত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ছিল। তবে এপ্রিলে এ খাতের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটি ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৫২ শতাংশ কম। এদিকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানিতে ভালো সংবাদ নেই। গত অর্থবছর ১১৬ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি হলেও চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত হয়েছে ৭৪ কোটি ডলারের। গত বছরের তুলনায় এবার এ খাতের রপ্তানি কমেছে ২৮ শতাংশ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি একসঙ্গে কমায় অর্থনীতিতে অবশ্যই চাপ বাড়বে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডলারের বিনিময় মূল্যে বড় ধরনের সমন্বয় আনতে হবে। সেটি কষ্টদায়ক হলেও করতে হবে। একটু একটু করে সমন্বয়ে সাময়িক স্বস্তি হয়তো আসবে, তবে টেকসই কিছু হবে না।
কারণ, ডলারের বাজারদর বেশি। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করায় তাদের পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কিন্তু বেড়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়াতে হবে। তাহলে বাজারে তারল্য কমবে। অন্যদিকে যারা রপ্তানি আয় দেশে আনতে গড়িমসি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।