মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার ও কম্প্রেসর উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর জন্য খারাপ খবর দিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এত দিন এসব পণ্য উৎপাদনকারীরা ১০ শতাংশ করপোরেট কর দিতেন। আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছর থেকে তাঁদের ২০ শতাংশ কর দিতে হবে। এ ছাড়া এসব পণ্যের খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারীরাও একইভাবে বাড়তি করের আওতায় চলে আসবেন। এতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের ওপর করের চাপ আরও বাড়তে চলেছে।
এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সে অনুযায়ী এই খাতের উদ্যোক্তাদের ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০৩২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়তি কর দিতে হবে। অর্থাৎ তাঁদের প্রায় সাত বছর বাড়তি করের বোঝা বইতে হবে।
এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এক-দুই দশক ধরে বেড়ে ওঠা মোটরসাইকেল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য খাতের ওপর করের চাপ বাড়বে। এতে কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমবে। ফলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে উৎপাদন সংকুচিত হতে পারে।
এনবিআর কিছুটা ঘুরিয়ে প্রজ্ঞাপনটি জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, এসব পণ্যের উৎপাদকদের অর্জিত আয়ের ওপর প্রদেয় করহার কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের দাবি, বাস্তবে আয়কর হার কমানো হয়নি।
বিষয়টি খোলাসা করা যাক, নতুন প্রজ্ঞাপনে ২০২১ সালের অক্টোবরে জারি করা এ–সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। এতে এসব খাত থেকে ১০ শতাংশ করপোরেট করহার উঠে যায়। ফলে ওই সব খাতের করপোরেট করহার নিয়মিত করে পরিণত হয়। অর্থাৎ করহার বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত। সেই করহার কমিয়ে এখন ২০ শতাংশ করা হয়েছে। বাস্তবে করহার বেড়েছে।
• বর্তমানে দেশে বছরে ৩০ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হয়। এই পণ্যের বাজার বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। • জাতীয় মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিতে মোটরসাইকেল উৎপাদনে করছাড়ের কথা উল্লেখ আছে। সুতরাং কর বৃদ্ধি ওই নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এসব খাতের উদ্যোক্তারা গত এক-দুই দশকে বেশ ভালো করেছেন। তাঁদের এখন একটু বাড়তি দেওয়ার সময় এসেছে।
২০ শতাংশ করের সুবিধা পেতে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। যেমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত হতে হবে এবং আয়কর আইন প্রতিপালন করতে হবে। ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব মোল্ড ও ডাইস তৈরির ক্ষমতা থাকতে হবে। এ ছাড়া ফোমিং প্ল্যান্ট, পাওয়ার কোটিং প্ল্যান্ট এবং সক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
এ ছাড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি বিদ্যমান ব্যবসার পুনর্গঠন বা এমন ব্যবসা বিভাজন দ্বারা গঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান অথবা বাংলাদেশে বিদ্যমান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেশিনারি বা স্থাপনা হস্তান্তরের মাধ্যমে গঠিত কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হতে পারবে না।
দেড় দশক আগে দেশে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ উৎপাদন শুরু হয়। তার আগে পণ্যটি আমদানিনির্ভর ছিল। বর্তমানে দেশে বছরে কমবেশি ৩০ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হয়। বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে এটির বাজার বড় হচ্ছে। তবে ফ্রিজের বাজারের সিংহভাগই বর্তমানে দেশীয় কোম্পানিগুলোর দখলে। শুধু তাই নয়, দেশে ফ্রিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কম্প্রেসরও উৎপাদন হচ্ছে। ফ্রিজের দেখানো পথ ধরে দেশে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) উৎপাদন শুরু হয়েছে।
ইলেকট্রনিক খাতের উদ্যোক্তারা বলেন, দেশে উৎপাদন করলে যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক-কর কম লাগে। পুরো তৈরি অবস্থায় পণ্য আমদানি করলে খরচ অনেক বেশি পড়ে। সে কারণে দেশীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও দেশে ফ্রিজ, এসি, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যের কারখানা স্থাপনে মনোযোগী হয়েছে।
করপোরেট কর বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ইলেক্ট্রো মার্টের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আফসার বলেন, সরকার বিভিন্ন ধরনের নীতি–সহায়তা দেওয়ায় ইলেকট্রনিক পণ্যে দেশের সক্ষমতা বাড়ছে। এখন করপোরেট কর একলাফে ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করায় একধরনের বাধা সৃষ্টি হলো। এতে বিনিয়োগ বা পুনর্বিনিয়োগ কমবে। করপোরেট কর একবারে দ্বিগুণ না করে ধাপে ধাপে বাড়ানোর সুযোগ ছিল। বর্তমান অস্থির সময়ে এমন সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের নেতিবাচক বার্তা দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মোটরসাইকেল উৎপাদন ও সংযোজনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এমনিতে এখন মোটরসাইকেলের ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন করে করের চাপ বাড়লে ব্যবসা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল উৎপাদনে ঝুঁকছে। এখন বাড়তি করারোপের শর্ত আরোপ না করলে ভালো হয়। তাতে পরিবেশবান্ধব গাড়ি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়বে।
২০১৮ সালের জাতীয় মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতি অনুসারে, ২০২৭ সালের মধ্যে ১০ লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের কথা উল্লেখ আছে। নীতিমালায় সরকার দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদনে করছাড় ও কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছিল। কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ওই নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।