প্রায় দুই দশক ধরে তাঁতের সুতায় ডাইং বা রং করা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসায়ে যুক্ত আছেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার চন্দনগাঁতী গ্রামের বাসিন্দা আশিস কুমার চৌধুরী। সুতা ডাইং বা রং করার প্রক্রিয়ায় দূষিত বর্জ্য এত দিন তিনি পার্শ্ববর্তী পুকুরে ফেলতেন। এতে শুধু পুকুরই নয়, আশপাশের এলাকায়ও দূষণ ছড়াত। তবে কয়েক মাস আগে নিজের কারখানায় একটি তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করেছেন তিনি। ফলে দূষণ কমেছে।
মা কালী কালার ডাইংয়ের স্বত্বাধিকারী আশিস কুমারের মতো সিরাজগঞ্জ জেলায় আরও তিনজন ডাইং উদ্যোক্তা সম্প্রতি তাঁদের কারখানায় ইটিপি স্থাপন করেছেন। অথচ এই জেলার ৯টি উপজেলায় ডাইং কারখানা রয়েছে প্রায় তিন শ। অর্থাৎ ব্যাপক হারে দূষণ ঘটাচ্ছে কারখানাগুলো। তবে আশার কথা হলো, উদ্যোক্তাদের মধ্যে পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা বাড়ছে। কয়েকজন প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁরা পরিবেশসম্মত ইটিপি স্থাপনে উদ্যোগ নিচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংক ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) দেশে টেকসই ও পরিবেশসম্মত ব্যবসা উদ্যোগ বাড়াতে ২০১৯ সালে ১৩ কোটি মার্কিন ডলারের ‘সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট’ (এসইপি) বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটির অধীনে সারা দেশে ৬৪টি উপপ্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের সদর, কামারখন্দ ও বেলকুচি উপজেলায় এসইপি তাঁত উপপ্রকল্প একটি। এর আওতায় আশিস কুমারসহ চারজন উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে ইটিপি স্থাপন করেছেন। এ ছাড়া প্রকল্পটির আওতায় পরিবেশ সুরক্ষায় আরও কিছু উদ্যোগ রয়েছে।
সম্প্রতি পিকেএসএফের আয়োজনে ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক সরেজমিনে প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। তখন তাঁতী ও ডাইং প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এলাকার পরিবেশগত ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনের নানা গল্প জানা যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের অন্যতম শীর্ষ জেলা সিরাজগঞ্জ। দেশের মোট তাঁতের সাড়ে ৮ শতাংশ রয়েছে সিরাজগঞ্জে। জেলার ৯টি উপজেলার ২২৫টি তাঁত কারখানায় তাঁত রয়েছে ৯ হাজার ৭৬৫টি, আর ডাইং কারখানা আছে প্রায় তিন শ। এসব কারখানার মালিকেরা পরিবেশ বিষয়ে তেমন সচেতন না হওয়ায় এবং নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ায় ইটিপি স্থাপনে আগ্রহ দেখান না।
পিকেএসএফের কর্মকর্তারা বলেন, তাঁত–অধ্যুষিত এলাকায় শব্দ, মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ একটি সাধারণ ঘটনা। তাঁরা জানান, জেলার তামাই ও বেলকুচি এলাকার ছোট–বড় ২৭৫টি ডাইং ও প্রসেসিং কারখানায় দৈনিক গড়ে ১ হাজার লিটার তরল বর্জ্য উৎপাদন হয়, যা কোনো রকম শোধন ছাড়াই আশপাশের জলাশয়ে পড়ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রোকনুজ্জামান বলেন, দূষণের কারণে তাঁত–অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। বিশেষ করে এলাকার গর্ভবতী নারী ও শিশুরা বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়।
মূলত দূষণ প্রক্রিয়ার এই জায়গাতেই পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে পিকেএসএফ। পিকেএসএফের নেওয়া উপপ্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
এনডিপির কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রকল্প এলাকায় তাঁত পণ্য উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ও আধুনিক প্রযুক্তির
ব্যবহার বাড়ানো।
বেলকুচির মা কালী কালার ডাইংয়ের স্বত্বাধিকারী আশিস কুমার বলেন, ‘পরিবেশদূষণ কমাতে আত্মোপলব্ধি থেকে আমি ইটিপি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ইটিপি স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ২৬ লাখ টাকা। ইটিপি স্থাপনের আগে যে পুকুরে বর্জ্য ফেলে দূষিত করেছিলাম, সেটিতেই এখন মাছ ও হাঁস চাষের পরিকল্পনা করছি আমি।’
এসইপি তাঁত উপপ্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. আশরাফুজ্জামান জানান, তাঁরা দৈনিক ৩, ৫ ও ১০ হাজার লিটার সক্ষমতার তিন ধরনের ইটিপির নকশা তৈরি করেছেন। ইতিমধ্যে তিন উপজেলার চার কারখানায় ছোট বা মিনি-ইটিপি স্থাপিত হয়েছে। আরও কয়েকজন ইটিপি স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল গফুর বলেন, ‘পুরো জেলায় ইটিপির ব্যবহার বাড়াতে কারখানা মালিকদের আমরা নিয়মিত কাউন্সেলিং করছি এবং আইনেরও প্রয়োগ শুরু করেছি।’
সিরাজগঞ্জে এসইপি তাঁত উপপ্রকল্পের আওতায় ছয়জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ডাইং পদ্ধতি শেখানো হয়েছে। উদ্যোক্তারা এখন শাড়ির পাশাপাশি লুঙ্গি, পাঞ্জাবির কাপড়, চাদর ইত্যাদিও তৈরি করছেন। সাধারণ বা বৈদ্যুতিক তাঁতে শব্দ অনেক বেশি হয়। এ জন্য এসইপির সহায়তায় পাঁচজন উদ্যোক্তা উচ্চক্ষমতার র্যাপিয়ার পাওয়ারলুম স্থাপন করেছেন। এতে শব্দদূষণ কমেছে।
সে রকমই এক উদ্যোক্তা বেলকুচির তৌহিদ কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মো. তৌহিদ হাসান বলেন, ‘র্যাপিয়ার পাওয়ারলুম স্থাপনের পরে তাঁতে পণ্য উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে।’
প্রকল্পটির আওতায় পণ্য বৈচিত্র্যকরণের অংশ হিসেবে কয়েকজন উদ্যোক্তা তাঁতে পাটপণ্য উৎপাদন শুরু করেছেন।
পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. ফজলুল কাদের মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দূষণের একটি টেকসই ও বাণিজ্যিক সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করছি। এতে স্থানীয় ক্ষুদ্র তাঁত উদ্যোক্তারা ক্লাস্টার ভিত্তিতে ইটিপি স্থাপনের মাধ্যমে লাভবান হতে পারছেন এবং পরিবেশদূষণও কমছে। তবে এ উদ্যোগের সুফল পেতে উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে।’