ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়া গ্রাহকেরা নিজেদের পাওনা টাকা ফেরত পাচ্ছেন। তবে ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া একটু ধীরগতির।
মোট ২৭টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকেরা পান ৫২৫ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ১৩টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের ৩৬১ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। এখনো ১৬৪ কোটি টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকেরা।
এ টাকা অবশ্য ২০২১ সালের ৩০ জুনের পর থেকে ২৭টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে পণ্য ক্রয়াদেশের বিপরীতে গ্রাহকদের টাকা আটকে ছিল। টাকাগুলো ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লেনদেন পরিশোধকারী কোম্পানিতে (পেমেন্ট গেটওয়ে) আটকে ছিল এবং আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই বলে আসছে, ২০২১ সালের ৩০ জুনের পরে দেওয়া টাকা গ্রাহকেরা ফেরত পাবেন।
২০২১ সালের ৩০ জুন তারিখটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে, এদিন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ‘এসক্রো’ ব্যবস্থা চালু করে। এ ব্যবস্থা হচ্ছে গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছানোর পর টাকা পরিশোধ নিশ্চিত করা। কিন্তু তা মেনে চলেনি অভিযুক্ত কোম্পানিগুলো।
গ্রাহকদের পাওনা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি দেখভাল করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল। এ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন পাওনা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে।
সফিকুজ্জামান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এরপর দায়িত্ব পান একই মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান, যিনি অবসরোত্তর ছুটিতে যান এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি।
টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া একটু ধীর হলেও ফেরত দেওয়ার উদ্যোগটার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রশংসার দাবিদার। মাথায় রাখতে হবে যে ভবিষ্যৎ ই-কমার্স খাতের। তাই খাতটির প্রতি অবহেলা করলে আমরা পিছিয়ে পড়ব।সুবর্ণ বড়ুয়া, ই-কমার্সবিষয়ক গবেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গতকাল মঙ্গলবার রাতে হাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘যে পদ্ধতি দাঁড় করানো হয়েছে, তাতে গেটওয়েতে থাকা টাকা আগে-পরে সবাই ফেরত পাবেন বলে আশা করা যায়। তবে ২০২১ সালের ৩০ জুনের আগের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অবশ্য কম।’
হাফিজুর রহমানের পর একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুসরাত জাবীন বানু ডব্লিউটিও অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেলেও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি এ দায়িত্বে এসেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রুহুল আমিন। জানা গেছে, চলতি সপ্তাহেই তিনি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া জোরদার করতে একটি বৈঠক করেছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে আটকে থাকা গ্রাহকের টাকা জমা রয়েছে মোট পাঁচটি পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানে। এগুলো হচ্ছে বিকাশ, নগদ, সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল), সূর্যমুখী লিমিটেড ও ফস্টার করপোরেশন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২৭টির মধ্যে ১২টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ২৫ হাজারের বেশি গ্রাহকের কোনো টাকাই ফেরত দেয়নি। আর ১৩টি ফেরত দিয়েছে আংশিক। ফেরত না দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিরাজগঞ্জ শপ, নিডস, টোয়েন্টিফোর টিকেট, ই-অরেঞ্জ, উইকুম, আকাশ নীল, আলাদীনের প্রদীপ, সফেটিক, আমার বাজার, আস্থার প্রতীক, বাড়ির দোকান ডটকম, ইনফিনিটি মার্কেটিং ইত্যাদি। দুটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত সচিব রুহুল আমিনের সভাপতিত্বে এ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেওয়া সূত্রগুলো জানায়, আলাদীনের প্রদীপ ও সিরাজগঞ্জ শপের ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকায় তারা টাকা ফেরতের উদ্যোগ নিতে পারেনি। আর ধামাকা শপিংয়ের মালিকপক্ষের নিজের অন্য কোম্পানিতে ঋণ রয়েছে। কিন্তু ঋণের তথ্য প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছে না। আবার সিরাজগঞ্জ শপ ও গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান নগদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ শপ, দালাল প্লাস, ধামাকা শপিং ও আলাদীনের প্রদীপের মধ্যে শুধু আলাদীনের প্রদীপের ব্যাংক হিসাবেই আছে পাঁচ কোটি টাকার বেশি। বাকিদের টাকা কম।
নগদ, সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল), ফস্টার করপোরেশন, সূর্যমুখী লিমিটেড ও বিকাশ-এ পাঁচ গেটওয়েতেই আটকে রয়েছে টাকা। সর্বোচ্চ ২৯৬ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে কিউকম।
এদিকে ইভ্যালিতে আটকে আছে গ্রাহকদের ২৬ কোটি টাকা। এই টাকার মধ্যে নগদে ১৮ কোটি, বিকাশে প্রায় ৫ কোটি ও এসএসএলে ৩ কোটি টাকা রয়েছে। ইভ্যালি এখন পর্যন্ত গ্রাহকদের তিন কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া এসএসএলে আটকে আছে ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের ৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ই-কমার্সবিষয়ক গবেষক সুবর্ণ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া একটু ধীর হলেও ফেরত দেওয়ার উদ্যোগটার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রশংসার দাবিদার। মাথায় রাখতে হবে যে ভবিষ্যৎ ই–কমার্স খাতের। তাই খাতটির প্রতি অবহেলা করলে আমরা পিছিয়ে পড়ব।’