ট্যানারি বা চামড়াশিল্প খাতের শ্রমিকদের জন্য নতুন নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করেছে সরকার। বিভাগীয় শহর ও ঢাকার সাভার এলাকায় অবস্থিত ট্যানারির জন্য সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার ১ টাকা; আর অন্যান্য স্থানের জন্য এ মজুরি ১৭ হাজার ৪৮ টাকা। দেশের অধিকাংশ ট্যানারিই সাভারের চামড়া শিল্পনগরে অবস্থিত।
এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালে এ খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল। তখন বিভাগীয় ও সাভার এলাকার ট্যানারিশ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ছিল ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। সে তুলনায় নতুন কাঠামোতে মজুরি বেড়েছে প্রায় ৩৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী ট্যানারিশিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য নিম্নতম মজুরিসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গ্রেড ও এলাকাভেদে ট্যানারিশিল্প খাতে নিম্নতম মজুরি হবে ১৭ হাজার ৪৮ টাকা, আর সর্বোচ্চ মজুরি হবে ৩৪ হাজার ১৬৮ টাকা। মোট পাঁচটি গ্রেডে ট্যানারিশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রেডে মজুরির ক্ষেত্রে বিভাগীয় শহর ও সাভার এলাকা এবং অন্যান্য এলাকাভিত্তিক—এই দুই শ্রেণি রাখা হয়েছে। দুই শ্রেণিতেই শ্রমিকদের মূল মজুরি, চিকিৎসা ও যাতায়াত ভাতা সমান রাখা হয়েছে। তবে বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে ভাতায় পার্থক্য রয়েছে। বিভাগীয় শহর ও সাভারের ক্ষেত্রে মূল মজুরির ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকায় মূল মজুরির ৬০ শতাংশ বাড়িভাড়া রাখা হয়েছে।
ট্যানারি বা চামড়াশিল্প খাতের নতুন মজুরিকাঠামোতে সর্বোচ্চ বা প্রথম গ্রেডে রয়েছেন স্কিন সিলেক্টর বা হ্যান্ড মেজারার, বৈদ্যুতিক ও মেশিন মেরামত মিস্ত্রি, হ্যান্ড ফ্রেশারম্যান ও বয়লার অপারেটরসহ ১৩ ধরনের শ্রমিক। বিভাগীয় শহর ও সাভারে এই গ্রেডের শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪ হাজার ১৬৮ টাকা, যা ২০১৮ সালে ছিল ২৫ হাজার ৪০০ টাকা।
এভাবে বিভাগীয় শহর ও সাভার এলাকার ট্যানারিশ্রমিকের নিম্নতম মজুরি বাড়িয়ে দ্বিতীয় গ্রেডে ২৮ হাজার ৩৮৮ টাকা; তৃতীয় গ্রেডে ২৪ হাজার ২ টাকা এবং চতুর্থ গ্রেডে ২০ হাজার ৯৯৩ টাকা করা হয়েছে। এই চার গ্রেডের বাইরে অদক্ষ সাধারণ ও অন্য শ্রমিকেরা রয়েছেন সর্বশেষ বা পঞ্চম গ্রেডে। এই গ্রেডের নিম্নতম মজুরি বিভাগীয় শহর ও সাভারে ১৮ হাজার ১ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ১৭ হাজার ৪৮ টাকা।
২০১৮ সালে দ্বিতীয় গ্রেডে ২১ হাজার ১৫০, তৃতীয় গ্রেডে ১৭ হাজার ৯২০, চতুর্থ গ্রেডে ১৫ হাজার ৭১০ ও পঞ্চম গ্রেডে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি ছিল। এ ছাড়া শিক্ষানবিশ শ্রমিকের ক্ষেত্রে এবার নিম্নতম মজুরি ১১ হাজার ৩৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৭ হাজার টাকা। শিক্ষানবিশকাল ধরা হয়েছে তিন মাস।
প্রজ্ঞাপনে ট্যানারিশিল্পের শ্রমিকের পাশাপাশি কর্মচারীদের নিম্নতম মজুরিও ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কর্মচারীদের ক্ষেত্রে মোট গ্রেড করা হয়েছে চারটি। এর মধ্যে সর্বনিম্ন বা চতুর্থ গ্রেডে রয়েছেন পিয়ন, দারোয়ান, নৈশপ্রহরী, মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বিভাগীয় শহর ও সাভার এলাকায় তাঁদের নিম্নতম মজুরি ১৮ হাজার টাকা। আর প্রথম গ্রেডের কর্মচারীদের নিম্নতম মজুরি বিভাগীয় পর্যায়ে ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ১৬৮ টাকা। কর্মচারীর ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশকাল ছয় মাস এবং তাঁদের নিম্নতম মজুরি ১১ হাজার ৩৩০ টাকা।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শ্রমিক-কর্মচারীরা বর্তমানে যে যে গ্রেডে কর্মরত রয়েছেন, সেই গ্রেড অনুসারে তাঁদের নতুন মজুরিকাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। কোনো শ্রমিককে নিম্নতম মজুরির চেয়ে কম মজুরি দেওয়া যাবে না। আবার কেউ ইতিমধ্যে নিম্নতম মজুরির চেয়ে বেশি মজুরি পেলে তাঁর মজুরি কর্তন করা যাবে না। এ ছাড়া নিম্নতম মজুরির প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর থেকে প্রতিবছর মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বাড়বে।
এর আগে গত মে মাসে ট্যানারিশিল্পের শ্রমিকদের জন্য ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেছিল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এমন মজুরি বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছিল সংস্থাটি। সিপিডি জানায়, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে ট্যানারি বা চামড়াশিল্প খাতের একটি শ্রমিক পরিবারের প্রয়োজনীয় খাবারের খরচ মাসে ২০ হাজার ৫৬৪ টাকা। আর খাদ্যবহির্ভূত খরচ ১২ হাজার ৯১৪ টাকা। একটি শ্রমিক পরিবারের গড় সদস্যসংখ্যা ৪ দশমিক ৬ জন। এর মধ্যে উপার্জনক্ষম সদস্য ১ দশমিক ৫ জন। সে হিসাবে একজন শ্রমিকের মাসিক ন্যূনতম মজুরি হওয়া দরকার ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা। এর আগে চলতি বছরের শুরুর দিকে ট্যানারিশ্রমিকেরা ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দীর্ঘ ১১ মাস ধরে মজুরি নির্ধারণপ্রক্রিয়া আটকে ছিল। নতুন মজুরিকাঠামো শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন অনুসারে হয়নি। এ ছাড়া তিন বছর ধরে কোনো ইনক্রিমেন্টও হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে মজুরি বিষয়ে একটি ফয়সালা হওয়া জরুরি ছিল। তাই নতুন মজুরিতে খুব খুশি হয়েছি, বলতে পারব না, তবে এটি মন্দের ভালো। তবে এ মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নে শ্রমিকেরা কোনো ছাড় দেবেন না।’