ব্যাংকঋণের সুদহার ও হঠাৎ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কোনো নীতিমালায় হঠাৎ পরিবর্তন না করে তাঁদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি নীতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায় যে লোকসান হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তরের প্রস্তাব করেছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব প্রস্তাব দেন ব্যবসায়ীরা। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ চার ডেপুটি গভর্নর ও বিভিন্ন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ব্যবসায়ীদের পক্ষে তাঁদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলমসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভা সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক করোনাকালে নানা নীতিমালা নিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ালেও এখন উল্টো নীতি নিচ্ছে। এর ফলে অনেক ব্যবসায়ী লোকসানে পড়েছেন। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধের অপেক্ষায় রয়েছে আরও অনেক কারখানা। তাঁরা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিলেও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। এমন সময় সুদের হার বাড়িয়ে ব্যবসাকে আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে।
সূত্রগুলো জানায়, ব্যবসায়ীদের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে যে সুদহার ১৪ শতাংশের ওপরে উঠবে না। আর ডলারের দাম ১১৭ টাকার আশপাশে থাকবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ডলারের চলমান সংকট কেটে যাবে।
সভা শেষে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম জানান, অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে যে ডলারের দাম ১১৭ টাকার মধ্যে থাকবে। ব্যাংকভেদে এক টাকা কমবেশি হতে পারে। প্রত্যেক ব্যবসায়ী যেন একই দামে ডলার পান, তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা বলেছি। এখনো ডলারের কিছু সমস্যা আছে, তবে আগের চেয়ে সমস্যা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংকট কেটে যাবে।’
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘বারবার নীতি পরিবর্তন করায় ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে। সামনে এভাবে বারবার নীতি পরিবর্তন হবে না বলে আমাদের জানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতি নিলে ভালো হয়, এটা আমরা গভর্নরকে জানিয়েছি।’
সুদের হার প্রসঙ্গে মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে যে সুদহার নির্ধারণের দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সুদের হার ১৪ শতাংশের বেশি উঠবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ শতাংশ কমবেশি হতে পারে। এসএমই খাতের ওপর অতিরিক্ত ১ শতাংশ মাশুল প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে ব্যবসায়ী নেতাদের জানানো হয়েছে। তবে সভায় এমন কোনো নির্দেশনার প্রজ্ঞাপন বা নথি বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাতে পারেনি।
এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যবসায়ী ১০০ কোটি টাকা, কেউ আবার ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার লোকসানে পড়েছেন। এসব হিসাব ব্যাংকগুলোর কাছে আছে। এই লোকসানের অর্থ দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে পুনঃ তফসিল করে দেওয়ার জন্য আমরা বলেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এতে রাজি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো সৎ ব্যবসায়ী অর্থ পাচার করতে পারেন না। আমরা অসৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নেই।’
সভা শেষে তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই-তিন মাসের মধ্যে আর্থিক পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল ছাড়া অন্য এলাকায় স্থাপন করা কারখানার জন্য ঋণ দেওয়া যাবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সিদ্ধান্ত, তা প্রত্যাহারের জন্য আমরা অনুরোধ করেছি। দেশের ৫০-৮০ ভাগ কারখানা এসব অঞ্চলের বাইরে অবস্থিত।’
নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার যে নতুন শর্ত ঠিক করা হয়েছে, তা শিথিল করার জন্য ব্যবসায়ীরা অনুরোধ করেছেন বলে তিনি জানান।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ডলারের দাম এত দিন ১১০ টাকা ছিল। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম আরও অনেক বেশি ছিল। এখন এর দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডলারের দাম যেন হঠাৎ করে না বাড়ে, তা নিশ্চিত করা দরকার।
জসিম উদ্দিন আরও বলেন, সুদহার ও ডলারের দামের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়বে। ডলারের দামের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করার জন্য পথনকশা প্রণয়ন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে ব্যবসা থেকে প্রস্থান করার কোনো নীতি নেই, এমন নীতিমালা করা দরকার।
সভায় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের মধ্যে আরও ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি আমীন হেলালী, টেক্সটাইল খাতের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ। আরও উপস্থিত ছিলেন মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের সিইও আহসান খান চৌধুরী ও সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাসান।